Reading Time: 5 minutes

ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নেয়া প্রায় কাছাকাছি বয়সের পাঁচ তরুণেরা, তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থেকেই এসেছেন, কিন্তু তাদের সবারই আগ্রহের বিষয় স্যাটেলাইট প্রযুক্তি। দেশে মহাকাশ প্রযুক্তি নিয়ে হওয়া ক্যাম্প ও সামিটে একপর্যায়ে তাদের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে ওঠে; এরপর নেমে পড়েন রকেট তৈরির কাজে। এই কাজে উক্ত পাঁচ তরুনেরা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন রিয়াদ এবং তার সঙ্গী হয়েছেন মোঃ মেহরাব হক, মোঃ একরামুল হাসান চৌধুরী, আবু সাইদ এবং তাহসিন হোসাইন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে সেই ‘রকেট মিশনের’ গল্প বলেছেন পাঁচ তরুণ।

সূচনা

২০১৮ সাল থেকে মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন রিয়াদ নিজের স্টার্টআপ স্পেসল্যাব গড়ে তোলেন। উক্ত বছর তিনি স্পেস ইনোভেশন সামিটে ক্যানস্যাট খুদে স্যাটেলাইট বানানো ও দেশের প্রথম ড্রপ টেস্টেও অংশ নিয়েছিলেন। প্রোটোটাইপ বা নমুনা মহাকাশযান (যেমন রকেট) নির্দিষ্ট উচ্চতায় উৎক্ষেপণ করে এর নানা দিক নিরীক্ষা করে দেখার প্রক্রিয়াকে ড্রপ টেস্ট বলে।  সেই সাথে নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে মেন্টর হওয়ার অভিজ্ঞতা তো আছেই।

বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের উদ্যোগে ২০১৯ সালে স্পেস ইনোভেশন ক্যাম্পে বাচ্চাদের রকেট বানানো শেখানোর মেন্টর হয়েছিলেন আবু সাইদ। আর মোঃ মেহরাব হক নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়া ঢাকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন দলের একজন ছিলেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বা ইউআইইউ হওয়া ওই আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন একরামুল হাসান চৌধুরীও। উক্ত ক্যাম্পে ওয়াটার রকেট বানিয়েছিলেন তাহসিন হোসাইন।

এরপর একরামুল হাসান চৌধুরীর মত বাকিদেরও মনে হয়েছে যে আরও কিছু করা সম্ভব।

গ্রাউন্ড স্টেশন, ক্যান স্যাটেলাইট এবং ওয়াটার রকেটের সমন্বয়ে ডেটা পাঠানো ও সংগ্রহ নিয়ে একটু একটু করে কাজ চলছিল এই পাঁচ তরুণের। ২০২১ সালে সরকারের আইসিটি ইনোভেশন ফান্ড প্রতিযোগিতায় নিজেদের ওই প্রজেক্ট জমা দেন তারা। অনেক নির্বাচন প্রক্রিয়া পেরিয়ে বিচারকদের চূড়ান্ত নির্ণয়ে বাকি কাজ এগিয়ে নিতে ফান্ড তো মেলেই, সেই সঙ্গে দিকনির্দেশনার অভাব পূরণে যোগ হন একজন মেন্টর।

পাঁচ তরুণের এই দলে সুপারভাইজার হিসেবে যোগ দেন আরিফুল হাসান অপু। বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা আরিফুল হাসান অপু এই পাঁচ তরুণের প্রকল্পের পেছনের কথা তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ব্যক্তিগতভাবে তারা দুই বছর আগে থেকেই কাজ করছিল। আর্থিক একটা বিষয় ছিল, তবে সুপারভিশনের কমতিটাই বড় ছিল। তিনি (অপু) আইসিটি ইনোভেশন ফান্ডের একজন বিচারকও ছিলেন। একটি অ্যাপ্লিকেশন ছিল যেটি নির্বাচিত হলে সরকার অফিসিয়ালি তাকে এই প্রকল্পের একজন মেন্টর হিসেবে যুক্ত করেছে।

প্রকল্পতে যা যা রয়েছে

ঢাকার মাদানী অ্যাভিনিউয়ে ইউআইইউ এর বড় মাঠে একটি ওয়াটার রকেট উৎক্ষেপণ করে নেওয়া হয় ২৬ দশমিক ৭৮ মিটার বা ৮৭ দশমিক ৮৬ ফুট উচ্চতায়। এরপর সাতটি সেন্সর নিয়ে ড্রপ টেস্ট করেও ডেটা সংগ্রহে সফলতা পাওয়া যায়। বিষয়গুলো আরেকটু ব্যাখ্যা করে রিয়াদ বলেন, এখানে তিনটি বিষয়, প্রথমত ওয়াটার রকেট দিয়ে ক্যান স্যাটেলাইট স্পেসে ডেপ্লয় করা। দ্বিতীয়ত, সহজে হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে এমন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে সার্কিট ও পুরো সিসটেম বানানো।

এই শিক্ষামূলক প্রকল্পের প্রথম ছয় মাসে তিনটি সেন্সর দিয়ে গ্রাউন্ড স্টেশন বানানোর কথা ছিল। কিন্তু স্পেসল্যাবের চিফ টেকনিক্যাল অফিসার মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন রিয়াদের দল সেই সময়ের মধ্যে পাঁচটি সেন্সর নিয়ে কাজ করেন। এ বছর জুনের মধ্যে আরও দুটো সেন্সর যোগ করেন তারা। রিয়াদ বলেন, এখন মোট সাতটি সেন্সর দিয়ে গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ঠিকঠাক মত ডেটা সংগ্রহ করা যাচ্ছে। ছোটখাট কয়েকটি পরীক্ষা হলেও পাঁচটি সেন্সর যোগ করে গুছিয়ে একটি পরীক্ষা হয় গত বছর ১৩ অক্টোবর।

তৃতীয় হচ্ছে একটি ওপেনসোর্স গ্রাউন্ড স্টেশন। বাংলাদেশে এখনও ওপেনসোর্স কাস্টমাইজ গ্রাউন্ডস্টেশন ব্যবহার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি বলে জানালেন আরিফুল হাসান অপু।

তিনি বলেন এমআইটি ও নাসার যে ওপেনসোর্স গ্রাউন্ড স্টেশন সফটওয়ার রয়েছে, সেটিকে নিয়ে এই ক্যান স্যাটেলাইটের মেকানিজমের সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এতে করে ডেটা নেওয়া সহজ হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থী ও তরুণরা স্যাটেলাইট-রকেট নিয়ে যেন আরও বেশি প্র্যাকটিক্যাল কাজ করতে পারে, সেজন্য একটি সাসটেইনেবল মডিউল তৈরি করাটাই  লক্ষ্য।

ওয়াটার রকেট ও ক্যান স্যাটেলাইট সম্পর্কিত কিছু তথ্য

সবুজ রঙের সিলিন্ডার আকারের একটি ওয়াটার রকেট দেখা গেল এই তরুণ দলের কাছে। রকেটের তলার দিকে তিনটি কোনাকৃতি অংশ রয়েছে; যেমন দেখা যায় নাসার মহাকাশে পাঠানো রকেটেও। রকেটটি কাঠের অবয়বের ওপর বসানো এবং এটি লঞ্চ প্যাড। এতে একটি ম্যানুয়াল গিয়ার বা লিভার যুক্ত আছে। পরে এই লিভার স্বয়ংক্রিয় ও ডিজিটাল করার পরিকল্পনা রয়েছে এই পাঁচ তরুণের। রকেটের ওপরে টুপির মত অংশ লাল রঙ করা, যাকে বলে নোজকোন।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে বানানো সিলিন্ডার ও নোজকোনসহ ওয়াটার রকেটের উচ্চতা সাড়ে চার ফুট; আর ব্যাস ২৫ মিলিমিটার। ওয়াটার রকেটের ভেতর এক ভাগ পানি ও দুই ভাগ বাতাস। উৎক্ষেপণের পরীক্ষার সময় পাম্পার দিয়ে ৮০ থেকে ১২৫ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চ) পর্যন্ত বাতাসের চাপ দেওয়া হয় রকেটের ভেতরে। এরপর লঞ্চ প্যাডের লিভারটি টেনে খুলে দিলে ওয়াটার রকেট উপরের দিকে ছুঁটে যায়। ফুয়েল রকেট বানানো খরচ সাপেক্ষ বলে শিক্ষামূলক এই গবেষণায় সাশ্রয়ী ওয়াটার রকেট প্রযুক্তি বেছে নেওয়া হয়েছে বলে জানান আরিফুল হাসান অপু।

এই প্রকল্পে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ডেটা পাঠানো ও সংগ্রহ। ক্যানস্যাট বা ক্যান স্যাটেলাইট।দিয়ে ডেটা পাঠানো হয়, আর গ্রাউন্ড স্টেশন সার্কিট ওই ডেটা সংগ্রহ করে। এরপর চলে ডেটা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ। স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে তা দেখাতে নমুনা স্যাটেলাইট বানানো হয়, যা হয়ত একটি কোমল পানীয়ের বোতলে এঁটে যাবে। এজন্যই এর নাম ক্যান স্যাটেলাইট বা ক্যানস্যাট। প্যারাসুট এখানে টার্মিনাল ভেলোসিটি যোগ করে।

এতে করে ক্যানস্যাটের ওজনের সমান ও বিপরীতে ওপরের দিকে একটি বল কাজ করে। তাতে লব্ধি বল শূন্য হয়ে যাবে।।তখন এর ওপর কোনো ত্বরণ কাজ করবে না। অর্থ্যাৎ ক্যান স্যাটেলাইট একটি নির্দিষ্ট গতি নিয়েই নিচে নামবে। আকারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তাহসিন বলেন এই প্যারাসুট বা ক্যানোপির আকার আবার নির্ভর করছে ক্যানস্যাটের ভর এবং প্রান্তিক বেগের (টার্মিনাল ভেলোসিটি) ওপর। যদি বেশি বেগ নিয়ে ক্যানস্যাট নামাতে হয়, তবে ক্যানোপির আকার কমে আসবে।

একইভাবে ধীর গতিতে ক্যানস্যাট নামাতে চাইলে ক্যানোপির আকার হবে বড়। তিনি আরো জানান, তাদের প্রকল্পে বানানো ক্যানস্যাটটির ওজন ৫০০ গ্রামের মত। যে কারণে প্যারাসুটের কাপড়ের ওজন এখানে নগণ্য হয়ে যায়। কিন্তু নাসার যেসব স্পেসক্রাফট পানিতে এসে পড়ে সেখানে ওজন গুরুত্ব রাখে তখন ক্যানোপির আকার, কাপড়-সুতা এসব ভিন্ন হবে। প্রাথমিকভাবে যে ক্যানোপি বানানো হয়েছে এর ডায়ামিটার আট থেকে নয় সেন্টিমিটার বলে জানান তিনি।

লক্ষ্য ছিল, ওয়াটার রকেট সর্বোচ্চ উচ্চতা পর্যন্ত ওঠার পর যখন ক্যানস্যাট আলাদা হয়ে যাবে একইসঙ্গে ক্যানোপিও খুলে যাবে। কিন্তু ক্যানস্যাট নিচে নামার সময় ক্যানোপি খুলতে সময় নিয়েছিল। মেকানিক্যাল কারণে ওই একটুখানি সময় দেরি হয়েছিল। এরপর ক্যানোপি খুলে গেলে ক্যানস্যাট লিনিয়ার ভেলোসিটিতে নেমেছে। তবে এই বিষয়টিও নজরের বাইরে রাখতে চান না জানিয়ে তিনি বলেন, মেকানিক্যাল ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে হবে সামনে। প্যারাসুটের এরিয়াটা বাড়াতে চাই।

তাহলে এটা আরেকটু স্লো নামবে। তাতে আমরা আরও বেশি পরিমাণে ডেটা পাব। আর রকেট কতটুকু ওপরে উঠবে সে উচ্চতা যদি খানিক বাড়ানো যায় তবে আমরা আরও বেশি ডেটা পাব।

রকেট উৎক্ষেপণের পর এক পর্যায়ে ক্যানস্যাট আলাদা হয়ে যায় এবং মাটির দিকে ছুটে নামতে থাকে। মাধ্যাকর্ষণের কারণে বস্তু যত নিচে নামতে থাকে ততই গতিবেগ বাড়তে থাকবে। গতি কমিয়ে আনতে না পারলে ক্যান স্যাটেলাইট সজোরে মাটিতে আঘাত করে নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সংঘর্ষ এড়াতে এই ক্যান স্যাটেলাইটের সঙ্গে প্যারাসুট জুড়ে দেওয়া হয়।

উৎক্ষেপণের আগে ক্যানস্যাট সার্কিট ও প্যারাসুট দুটোই রকেটের ওপরের অংশে ভরে দেওয়া হয়। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে ক্যান স্যাটেলাইটের এসব কারিগরি দিক ব্যাখ্যা করছিলেন তাহসিন হোসাইন।

স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে

আগামী এক বছরে সারা দেশে অন্তত ১০টি দলকে ওয়াটার রকেট, ক্যান স্যাটেলাইট বানানো, লঞ্চিং এবং গ্রাউন্ড স্টেশনে ডেটা সংগ্রহ হাতে-কলমে শেখাতে চায় পাঁচ তরুণের এই দলটি। তাদের মেন্টর আরিফুল হাসান অপু বলেন, দলে একেকজন একেক বিষয়ে দক্ষ হলেও সবার লক্ষ্য একটাই। আবু সাঈদ আর একরামুল হোসেন চৌধুরী দুজনেই রকেট বানানোয় কাজ করছেন। এদের মধ্যে আবু সাঈদ কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন।

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেকট্রিক্যাল বিভাগে শেষ বর্ষে পড়ছেন একরামুল হোসেন চৌধুরী। একরামুল জানান রোবটিকস আর রকেট নিয়ে কাজ করার মত ইচ্ছে ছিল তার। আর মেহরাব হকের স্যাটেলাইট ভিত্তিক প্রজেক্ট করার পর স্পেস ভিত্তিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, এখন এই প্রজেক্টে ক্যানস্যাটেলাইটে কিছু কাজ ছিল। তিনি আগে মাইক্রো কন্ট্রোলার নিয়ে কাজ করেছে। সবমিলিয়ে এখনকার প্রজেক্টটা তার জন্য বেস্ট ফিট।

cদশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই রকেট-স্যাটেলাইট নিয়ে আগ্রহ জন্মে, তারপর এসব নিয়ে অনলাইন কোর্সও করেছিলেন বলে তাহসিন হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। সেন্ট জোসেফ হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে ২০২১ সালে এইচএসসি পাস করেন তাহসিন। ইচ্ছা ছিল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন তার পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ছেন।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.