আগামী রবিবার বাংলাদেশে পাবনার রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা চুল্লি উদ্বোধন হচ্ছে। রূপপুরের এই পারমাণবিক চুল্লি নির্মিত হয়েছে রাশিয়ায়। ভিভিআর-১২০০ মডেলের এই রিয়্যাক্টরে পরমাণু জ্বালানি পুড়িয়ে মূল শক্তি উৎপাদন হবে এবং ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর বা কমিশনিং প্রক্রিয়ায় এই চুল্লী স্থাপন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পরমাণু বিজ্ঞানীরা রিএ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলকে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হৃৎপিণ্ড বলে থাকেন। কর্তৃপক্ষ ধারণা দিচ্ছেন যে রূপপুরের প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে পারবে। রূপপুর কেন্দ্রে দুটি ইউনিটে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে একক প্রকল্প হিসেবে এটি সবচেয়ে বড় কোনো অবকাঠামো প্রকল্প।
পরমানু বিজ্ঞানী এবং আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শহীদ হোসেন বলেন, এই রিয়্যাক্টর স্থাপনের মধ্যে দিয়ে বলা যায় কমিশনিং প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। মহামারির মধ্যেও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৫ হাজার শ্রমিক দিনরাত সেখানে কাজ করছেন।
বিশেষজ্ঞগণের মান যাচাই
যদিও বর্তমান প্রযুক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনেকেই ব্যাপকভাবে আশাবাদী। কম খরচে উচ্চশক্তি সম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাপনা আসলেই বাংলাদেশের জন্য দারুন এক সফলতা, তবে নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে মান যাচাই এবং তদারকি প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগণ জানিয়েছেন। ভিয়েনায় অবস্থানরত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. শহীদ হোসেন বলেন, মূল সমস্যাগুলো যেমন এই প্রেসার ভেসেল একটা মূল সমস্যা, তারপরে পাম্প আছে অনেক।
সাথে পাম্পের অনেক ভালভ আছে, সেসব জিনিসগুলো দেখতে হবে তৈরির সময় ঠিকমতো তৈরি হচ্ছে কিনা। তাতে কোন ফল্ট আছে কিনা সেটিও যাচাই করতে হবে। আর সেগুলোর জন্য আমাদের লোকতো এত পারদর্শী নয়, তাই আমাদের আবার সাহায্য নিতে চ্ছে রাশিয়ার কাছ থেকেই।
ভীতির ভিত্তি কতটুকু?
জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে বর্তমানে বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপরে যে জোর দেয়া হচ্ছে পারমাণবিক শক্তি তার অন্যতম একটি উৎস। তবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লীর নিরাপত্তা নিয়ে অনেকের মাঝেই কিছু ভীতি কাজ করে থাকে। আন্তর্জাতিক আনবিক সংস্থার সাবেক একজন বিজ্ঞানী ড. শহীদ হোসেন বিবিসিকে বলেন, অনেকের মাঝেই ভয়টা এখনো রয়েছে। আর এই ভয়টা অনেক সময় না জানার কারণেও হয়। যদিও এই ভয়টা যতটা ধারণা করা হয় ঠিক ততটা আসলে নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অসতর্কতার ফলে দুর্ঘটনা ঘটার একটা ভীতি সবসময় কাজ করে অনেকের মধ্যেই। এ ভয়ের প্রবণতা কম বেশি সবখানেই রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, পারমাণবিক শক্তি নিয়ে যাদের ধারনা কম, তাদের মধ্যে অজানা ভয় কারন ছাড়াই কাজ করে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়েক স্তরে নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা হয়। যার ফলে দূর্ঘটনা ও ভয়ের কোন কারন নেই। অনিরাপদ বিদ্যু উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঝুকি কমাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। যদিও এটি ২০১১ সালের সময়কার ঘটনা এবং নিরাপত্তা বিষয়ে কর্তৃপক্ষ এতটা নজর দিতেন পারেননি। তবে বর্তমানে সময়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উচ্চমানের নিরাপত্তা প্রদান করা হচ্ছে। রাশিয়ার ভিভিআর ১২০০ মডেলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনা রোধে ৫টি স্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোন ছাড় দিচ্ছে না বাংলাদেশ।
মি. ওসমান বলেন আরো বলেন এখানে কো-ক্যাচার নামে একটি বাড়তি জিনিস লাগানো হয়েছে যেটা ফুকুশিমার ঘটনার পর আবিস্কৃত হয়ে অলরেডি চালু হয়ে গেছে। নতুন যে প্ল্যান্ট হয়েছে দুটোতে এই ব্যবস্থা লাগানো হয়েছে আর রূপপুরের তৃতীয়। কো-ক্যাচার ব্যবস্থা সম্পর্কে মি. ওসমান ব্যাখ্যা করে বলেন, কো-ক্যাচার বসানো হয়েছে কারন যদি আকস্মিকভাবে কোনরকম কোন ঘটনা ঘটেও তাহলে পুরো দূষিত জিনিসটা গলে নিচে পড়ে যাবে। একটা কুয়ার মতো যেটার মধ্যে পড়ে ওটা সিল হয়ে যাবে।
অর্থাৎ, তেজস্ক্রিয়তা ছড়াবে না এবং এটার স্লোগানই হলো মেক মোর সেফ, মোর সেইফ অ্যান্ড মোর সেইফ। এবং আমরাতো একেবারে সেরাটাই নিচ্ছি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন যে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে হলেও নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। যে কারণে নিরাপত্তাকেই সবচেয়ে গুরত্ব দেয়া হচ্ছে।
যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে
এদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে পরিবেশ বান্ধব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমান বিশ্বে একদিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসার প্রবণতা যেমন আছে, আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ঠেকাতে পরমাণুকে তেল কয়লার মতো ফসিল ফুয়েলের বিকল্প জ্বালানি হিসেবেও দেখছে অনেক দেশ। রূপপুরের পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা আছে বাংলাদেশের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম এ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভবিষ্যতের কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে বলেন, এগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। পাওয়ার প্ল্যান্ট রেডি করে রাখা হল, কিন্তু গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সির হেভি ফ্লাকচুয়েশনের কারণে যদি আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র না চালানো যায়, সেটাও চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তিনি বলেন, তাহলে গ্রিড সেভাবে নির্মিত হচ্ছে কি হচ্ছে না এটি দেখা জরুরি। অপারেটর তৈরি করা একটা চ্যালেঞ্জ, ফুয়েল হ্যান্ডলিং, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট একটা চ্যালেঞ্জ।
এছাড়া ইমারজেন্সি রেসপন্স – এগুলোর জন্য রেগুলেটর বডিতে যারা আছেন, তাদেরকে আরো দক্ষ হতে হবে, অভীজ্ঞ হতে হবে।