পারমাণবিক শক্তি কি সে সম্পর্কে অনেকেরই জানা আছে। তারপরও যদি পারমাণবিক শক্তি কি সে সম্পর্কে বলি সেটি হচ্ছে, পারমানবিক শক্তি বলতে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে তৈরি হওয়া ভিন্ন মৌলের একাধিক হাল্কা নিউক্লিয়াসকে বোঝায়। আরেকভাবে বলতে গেলে একাধিক পরমাণুর নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে ভিন্ন কোন মৌলের নিউক্লিয়াস তৈরি হলে শক্তির যে বিকিরণ ঘটে তাকে পারমাণবিক শক্তি বলে। এটি সাধারণত দুই ধরনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে। একটি হচ্ছে নিউক্লিয়ার ফিউশন এবং আরেকটি হচ্ছে নিউক্লিয়ার ফিশন।
নিউক্লিয়ার ফিউশন
দুটি বা তার বেশি নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে এক বা একাধিক ভিন্ন মৌলের পরমাণু তৈরি করার পর তাতে বিপুল শক্তি পাওয়া যায়। যেমন হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম যুক্ত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। সেই সাথে একটি নিউট্রন মুক্ত হয়। সূর্যে প্রচণ্ড মধ্যাকর্ষণের চাপের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিউশনেই ক্রমাগত শক্তি তৈরি হচ্ছে। সেখানে প্রায় ১ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ওই বিক্রিয়া ঘটছে। কিন্তু পৃথিবীতে ওই মাত্রায় চাপ তৈরি করা সম্ভব নয়। এজন্য ফিউশন বিক্রিয়া যদি ঘটাতে হয়, তাহলে তাপমাত্রা বাড়িয়ে মোটামুটি ১০ কোটি সেলিসিয়াসে নিতে হবে।
শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাস বা প্লাজমাকে বিজ্ঞানীরা শূন্যে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু নেই যেটি ১ কিংবা ১০ কোটি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে। ফলে ল্যাবরেটরিতে এ গবেষণা চালাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত গবেষণাগারে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটিয়ে যে পরিমাণ শক্তি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে, পুরো প্রক্রিয়া শুরুর জন্য তার চেয়ে বহু গুণ বেশি শক্তি খরচ করতে হচ্ছে। অক্সফোর্ডশায়ারে কুলহ্যামে জেইটির প্রায় ৪০ বছর ধরে এই ল্যাবে ফিউশন বিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা চলছে।
এর মধ্যে গত দশ বছর ধরে তারা আইটিইআর এর কৌশল অনুসরণ করে কাজ করছে। জেইটির এবারের গবেষণার জন্য দুটো ৫০০ মেগাওয়াটের ফ্লাইহুইল চালাতে হয়েছে, আর ফিউশনে ১১ মেগাওয়াট শক্তি তৈরি হয়েছে। বিবিসি লিখেছে, জেইটি ল্যাবকে আগামী বছরই অবসরে পাঠানো হবে। এরপর ফ্রান্সের আইটিইআর ল্যাবে ২০২৫ সাল থেকে প্লাজমা নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা শুরু হবে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পেরেছেন যে, বড় পরিসরে প্লাজমার পরিমাণ বাড়িয়ে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো গেলে খরচ করা শক্তির চেয়ে বেশিই উৎপাদন করা সম্ভব।
তবে সেজন্য আরো গবেষণা করতে হবে, পরিশ্রম চালিয়ে যেতে হবে এবং আরও অনেক সময় ও লাগতে পারে।
নিউক্লিয়ার ফিশন
ফিশন বিক্রিয়ায় একটি ভারী মৌলের পরমাণুকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হয়। তাতে ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি হাল্কা মৌলের পরমাণুতে পরিণত হয় এবং বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক শক্তি নির্গত হয়। আগে থেকেই এভাবে পারমাণবিক শক্তি তৈরির কৌশল মানুষ আয়ত্ত করছে। এই প্রক্রিয়ার ফলই হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর পারমাণবিক বোমা। ফিশন বিক্রিয়ার সময় ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস যখন ভেঙে যায় এবং তখন তিনটি নিউট্রনও উৎপন্ন হয়। সেই তিনটি নিউট্রন তখন আরও তিনটি নিউক্লিয়াসে আঘাত করে নতুন তিনটি বিক্রিয়ার সূচনা করে। তাতে আরও শক্তি এবং নয়টি নিউট্রন পাওয়া যায়।
পারমাণবিক চুল্লিতে ইউরেনিয়াম পরমাণুকে একটি নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে এর ফিশন ঘটানো হয়। সমস্যা হল, এর জ্বালানি সহজলভ্য নয় এবং এ প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়। তত্ত্বীয়ভাবে ফিশন বিক্রিয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে, যাকে বলে চেইন রিঅ্যাকশন। এই চেইন রিঅ্যাকশন অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকলে বিপজ্জনক পরিমাণ তাপ বিকরিত হয়। এই মূলনীতিতেই পারমাণবিক বোমা তৈরি হিয়েছে। কিন্তু চেইন রিঅ্যাকশনের সময় তৈরি হওয়া প্রতি তিনটি নিউট্রনের মধ্যে দুটি যদি শোষণ করার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এই ফিশন বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
তখন বিপদ না ঘটিয়ে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় তাপ উৎপাদন করা যায়। এই কৌশল ব্যবহার করেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়।
জ্বালানির উৎস হিসেবে নিউক্লিয়ার ফিউশনের উপকারিতা
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জয়েন্ট ইউরোপিয়ান টোরাস (জেইটি) ল্যাবরেটরির গবেষকরা বলছেন যে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটপ ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে তারা তাপ উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়েছেন। নিউক্লিয়ার ফিউশন নামের যে প্রক্রিয়ায় সূর্যের মত নক্ষত্রে শক্তি তৈরি হয়, ইউরোপীয় গবেষকরা পৃথিবীতে সেই প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের চেষ্টায় বড় ধরনের সাফল্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। বিবিসি জানায় যে সত্যিই যদি পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানো যায়, পরিবেশবান্ধব উপায়ে তার মধ্য দিয়ে দৃশ্যত অসীম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যাবে।
এ প্রক্রিয়ায় কার্বন নির্গামন বা তেজস্ক্রিয় নিঃসরণের ঝুঁকিও তেমন বাড়বে না। বিবিসি আরো বলে যে এবারের গবেষণায় যে পরিমাণ শক্তি তৈরি করা গেছে, তা দিয়ে ৬০ কেটলি পানি গরম করা যাবে। সেই অর্থে এটা অনেক বড় পরিমাণ শক্তি হয়ত নয়। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বিজ্ঞানীরা একটি কৌশল উদ্ভাবন করতে পেরেছেন যা দিয়ে আরও বড় আকারের ফিউশন রিঅ্যাক্টর তৈরি করা যাবে। জেইটি ল্যাবের গবেষকরা তাদের এবারের গবেষণায় ৫ সেকেন্ডে ৫৯ মেগাজুল শক্তি তৈরি করতে পেরেছেন। ১৯৯৭ সালে তাদের একই ধরনের গবেষণায় উৎপাদিত শক্তির দ্বিগুণেরও বেশি ছিল।
আইটিইআর (ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টর) এর কর্মসূচির অধীনে জেইটি ল্যাবরেটরির এ গবেষণা চলছে। দক্ষিণ ফ্রান্সে ওই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের গবেষণা এগিয়ে নিতে বেশ কয়েকটি দেশের একটি কনসোর্টিয়াম সমর্থন দিচ্ছে, যার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনও রয়েছে। রিঅ্যাক্টর ল্যাবের হেড অব অপারেশনস ড. জো মিলনেস বলেন যে জেইটির এই গবেষণা আমাদের ফিউশন পাওয়ারের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। এ গবেষণায় তারা এটাই দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে, যন্ত্রের মধ্যে তারা অতি ক্ষুদ্র একটি নক্ষত্রের জন্ম দিতে পেরেছেন।
সেই সাথে ৫ মিনিট সেটিকে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। এখানে যে পারফরম্যান্স তারা দেখাতে পেরেছেন, তা তাদের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবে। জেইটি ল্যাবরেটরির সিইও অধাপক ইয়ান চ্যাপমান বলেন যে গবেষণা তারা শেষ করেছেন তা বাস্তবেও কাজ করার কথা। যদি তা কাজ না করে, তাহলে আইটিইআর লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন উঠবে। বিবিসি জানিয়েছে যে এই শতকের দ্বিতীয় ভাগেই নিউক্লিয়ার ফিউশন একটি নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎস হয়ে উঠতে পারে, এই গবেষণার সাফল্য হয়ত সেটাই প্রমাণ করল। ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদুৎকেন্দ্র তৈরি করলে তাতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণ হবে না। স্বল্পস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হলেও তার পরিমাণ খুবই সামান্য হবে।