Reading Time: 5 minutes

২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন বাংলাদেশী মোবাইল ফোনের গ্রাহকরা। এর জন্য দায়ী কল ড্রপ এবং টেলিকম অপারেটরদের ড্রপ হওয়া কলের বিপরীতে ক্ষতিপূরণ দিতে না চাওয়ার মানসিকতা।

কল ড্রপ একটি বড় ধরনের সমস্যায় পরিনত হয়েছে। প্রত্যেক গ্রাহককেই একবার হলেও এই সমস্যার সম্মুখ্যিন হতে হয়েছে। এর মূল কারণ দুর্বল সিগনাল।

আজকাল প্রায়ই মোবাইলে কথা বলার সময় হুট করে লাইন কেটে যায়। কথা স্পষ্ট শোনা যায় না। ভেঙে ভেঙে কথা আসে। হ্যালো হ্যালো বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে যান মোবাইল ব্যবহারকারীরা। মুমূর্ষু রোগীর খোঁজখবর নেওয়া কিংবা বিপদে-আপদে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলার সময় যদি এভাবে লাইন কেটে যায়, তাহলে পরিস্থিতিটা কোন পর্যায় যেয়ে দাড়ায়? প্রযুক্তির ভাষায় এ সমস্যা ‘কল ড্রপ’ নামে পরিচিত। কলড্রপ, নেটওয়ার্ক সমস্যা, মিউট কল, ভাঙা কথাসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটসেবা।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) টেলিকম সেবার মান ও কল ড্রপ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি তৈরি করেছে। সম্প্রতি এই কমিটি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখান থেকে জানা গেছে এ বছরের জুনের আগের ১২ মাসে গ্রাহকরা কল ড্রপের কারণে ৫২ কোটি ৫৯ লাখ মিনিট টক টাইম হারিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলো বিটিআরসির ২০১৬ সালের নির্দেশনা অমান্য করেছে, যেখানে প্রতি মিনিট কল ড্রপের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে গ্রাহককে ফ্রি টক টাইম দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, অপারেটররা প্রতি ৩ থেকে ৭ মিনিটের বিপরীতে ১ মিনিট করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

২০২১ অর্থবছরে টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিপূরণ হিসেবে সর্বমোট ১১ কোটি ৪৫ লাখ মিনিট দিয়েছে, যেটি গ্রাহকদের খরচ করা টক টাইমের মাত্র ২২ শতাংশ। অর্থাৎ, ৪০ কোটি ৯৩ লাখ মিনিট কল ড্রপের বিপরীতে গ্রাহকদের প্রায় ১৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মিনিটে ৪৫ পয়সা সর্বনিম্ন কলরেটকে বিবেচনা করা হয়েছে।

গ্রাহকরা অন-নেট কলে ৩৭ কোটি ৬ লাখ মিনিট ও অফ-নেট কলে ১৪ কোটি ৯৯ লাখ মিনিট কল ড্রপের সম্মুখীন হয়েছেন। অপারেটরের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মধ্যে কল করলে (অর্থাৎ গ্রামীণ থেকে গ্রামীণ, রবি থেকে রবি) সেটাকে অন-নেট এবং অন্য নেটওয়ার্কে কল করলে (গ্রামীণ থেকে টেলিটক, রবি থেকে বাংলালিংক) সে কলগুলোকে অফ-নেট বলা হয়।

কল ড্রপ হওয়ার মূল কারণগুলো হলো নেটওয়ার্ক না পাওয়া, নেটওয়ার্ক কভারেজ এলাকার বাইরে চলে যাওয়া, টাওয়ার ক্যাপাসিটির বেশি মানুষ একই সময় একই এলাকায় চলে আসার কারণে নেটওয়ার্কে জট তৈরি হওয়া (ওভারলোডেড) ইত্যাদি। কল ড্রপের এ অবস্থার জন্য অন নেট কল ও অফ নেট কলও অনেকটা দায়ী। অন নেট হলো একই অপারেটরে কল দেওয়া, আর অফ নেট হলো ভিন্ন অপারেটরে কল দেওয়া। অর্থাৎ অন নেট ০১৭ থেকে ০১৭ নম্বরে কল দেওয়া আর অফ নেট ০১৭ থেকে ০১৫, ০১৬, ০১৮-এ কল দেওয়া বোঝায়। গ্

রাহকেরা গত এক বছরে অন নেট কলে ৩৭ দশমিক ৬ কোটি মিনিট এবং অফ নেট কলে ১৪ দশমিক ৯৯ কোটি মিনিট কল ড্রপের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এগুলো সবই অদৃশ্যমান। অর্থাৎ বিষয়গুলো খুবই টেকনিক্যাল ও ডিজিটাল হওয়ায় সাধারণ ব্যবহারকারী তা বুঝতে পারেন না।

এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, অপারেটররা শুধুমাত্র অন-নেট কল ড্রপের জন্য গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি গ্রাহকের অপারেটর গ্রামীণফোন বিটিআরসিকে মাত্র ২ মাসের অফ-নেট কলের তথ্য দিয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টের তথ্য দেওয়ার পর তারা কারিগরি সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে আর কোনো তথ্য দেয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটক কারিগরি সক্ষমতার অভাবের কথা বলে কোনো তথ্যই দেয়নি।

বিটিআরসির কমিটি মোবাইল অপারেটরদের টাওয়ারগুলোকে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত করতে না পারার ব্যর্থতাকেই কল ড্রপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্থানীয় টেলিকম অপারেটররা গ্রাহকদের কলে সংযুক্ত করার জন্য রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অপটিক্যাল ফাইবার অনেক বেশি উপযোগী মাধ্যম বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

গ্রামীণফোন এ যাবত তাদের মাত্র ১২ শতাংশ বেস ট্রান্সসিভার স্টেশনকে (বিটিএস) ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পেরেছে। রবি ও বাংলালিংক যথাক্রমে তাদের ১৮ ও ১৩ শতাংশ বিটিএসে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সংযোগ দিতে পেরেছে। টেলিটক কমিটিকে জানিয়েছে তাদের ৬০ শতাংশ টাওয়ার ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত আছে।

২২ সেপ্টেম্বরে একটি বৈঠকে কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়, ক্ষতিপূরণ হিসেবে গ্রাহকদের প্রাপ্য মিনিট দেওয়া হবে এবং এ ক্ষেত্রে কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা যাবে না।

বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কল বিঘ্নিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রাহকের টক টাইম ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তাদেরকে এসএমএসের মাধ্যমে সে বিষয়ে জানাতে হবে। গ্রাহকরা এই টক টাইম ব্যবহার করার জন্য ৩০ দিন সময় পাবেন।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

বিটিআরসি একইসঙ্গে টেলিটককে ৩ মাসের মধ্যে কল ড্রপের তথ্য সংগ্রহের কারিগরি সক্ষমতা অর্জনের নির্দেশ দেয় এবং বিঘ্নিত কলের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দিতে বলে।

রবির চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার সাহেদ আলম সম্প্রতি বলেন, ‘আমাদের ঐকান্তিক ও নিরন্তর চেষ্টার পরও ওয়্যারলেস প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে টেলিকম খাতে কল ড্রপ একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।’

‘তবে আমরা কল ড্রপের কারণে গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নীতিমালা মেনে চলছি’, বলেন তিনি।

বিটিআরসির নির্ধারণ করা কলের গুণগত মানদণ্ড অনুযায়ী ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ কল ড্রপ হতে পারে, যেটি বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

সাহেদ জানান, গত ১ বছরে রবির মোট কলের মধ্যে শূন্য দশমিক ৭ থেকে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ড্রপ হয়েছে। বাংলালিংকের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি আংকিত সুরেকা বলেন, ‘গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা নির্দেশ দেওয়ার আগেই গ্রাহকদের কল ড্রপের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছি।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমরা ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া চলমান রেখেছি এবং এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাওয়ার পর থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সব ধরণের তথ্য দিচ্ছি।

এ ব্যাপারে গ্রামীণফোনের কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন এমটবের মহাসচিব এস এম ফরহাদ জানান, লিফটের ভেতর, উঁচু দালানে, যাতায়াতের সময়, নেটওয়ার্ক পকেট পেরিয়ে যাওয়ার সময় অথবা আবহাওয়া খারাপ থাকলেও কল ড্রপ হতে পারে। তিনি জানান, মোবাইল অপারেটররা সম্প্রতি যে তরঙ্গ কিনেছেন, সেটি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তারা তাদের পুরো নেটওয়ার্কে ব্যবহার করবেন।

ফরহাদ বলেন, ‘মোবাইল অপারেটর, বিটিআরসি এবং নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন (এনটিটিএন) প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে। খুব শিগগির আমরা ইতিবাচক ফল দেখতে পাবো বলে আশা করছি।’

কলম্বো-ভিত্তিক আইসিটি পলিসি ও রেগুলেশন প্রতিষ্ঠান এলআইআরএনইএশিয়ার সিনিয়র ফেলো আবু সাইদ খান জানান, সাপ্লাই সাইডে বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলার সমাধান না করে বিটিআরসি মোবাইল সেবার গুণগত মান রক্ষা নিয়ে চাপ দিতে পারে না।

তিনি জানান, বিটিআরসি ২০১১ তে হঠাত করে মোবাইল অপারেটরদের নিজেদের উদ্যোগে অপটিকাল ফাইবারের রোলআউট প্রক্রিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন থেকে অসচ্ছল এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কও দিতে পারেননি বলে জানান আবু সাইদ খান।

তিনি আরও জানান, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, পুরো এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি ৫ লাখ গ্রাহকের জন্য বরাদ্দ করা তরঙ্গের (স্পেকট্রাম) পরিমাণ সবচেয়ে কম হওয়া সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা অপারেটরদেরকে অব্যবহৃত তরঙ্গ জমিয়ে রাখতে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘তাই, আমরা ধরে নিতে পারি ক্রমশ কমতে থাকা সেবার মানের নেপথ্যে রয়েছে বিটিআরসির আত্মবিধ্বংসী নীতিমালা।’

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.