কিছুদিন আগেও অ্যাপল সবচেয়ে বেশি বাজারমূল্য নিয়ে ছাড়িয়ে যাওয়া বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে দুঃখের বিষয় প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতায় অ্যাপলের শেয়ারমূল্য বছরের শুরুর অবস্থান থেকে শতকরা প্রায় ২০ ভাগ নেমে এসেছে। বর্তমানে অ্যাপল ছাড়াও বিপুল পরিমাণ সম্পদশালী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সীমা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে এগিয়ে রয়েছে। তাই বলা যায় বর্তমানে অ্যাপলই কেবল বিশ্বের সবচেয়ে দামী প্রতিষ্ঠান নয়।
যে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বৈশ্বিক জিডিপির শীর্ষে
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কেবল মানুষের জীবন-যাপনের ধরনই কেবল পরিবর্তন হয়নি, সেই সাথে সমাজ ও অর্থনৈতিক কাঠামো ও পাল্টেছে সমাজ। ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টিই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। আর এর মধ্যে ট্রিলিয়ন ডলারের তালিকায় থাকা ৫টি কোম্পানির মধ্যে অ্যাপল ছাড়াও রয়েছে অ্যারামকো, মাইক্রোসফট, আলফাবেট ও আমাজন, আর এগুলো সবই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। অনেক বিশ্লেশজকরাই আমাজন, গুগল, মাইক্রোসফটের কাছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের যতগুলো বৃহৎ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার সঙ্গে এসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত ছিল। করোনা মহামারির প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রযুক্তি বিশ্ব ছিল এর ব্যতিক্রম। এই সময়ে কিছু প্রযুক্তি কোম্পানি স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে মুনাফা অর্জন করেছে। প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক অনলাইন দুনিয়া মানব জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হয়েছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। যাদের একেকটার বাজারমূল্য বিশ্বের অনেক পরাশক্তি দেশের জিডিপির চেয়েও বেশি।
ফেসবুক, টুইটার ও গুগলের প্রধান নির্বাহীরা ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে দেশটির কংগ্রেসে সম্প্রতিকালে জেরার মুখে পড়েছে। সিএনবিসির একটি তথ্য বলছে যে ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু এক বছরে আমাজন, মাইক্রোসফট, আলফাবেট ও ফেসবুক ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার সম্মিলিত বাজার মূলধনে যুক্ত করেছিল । এই সময়ে শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বাজার মূলধন ছিল ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। যা বর্তমান বিশ্বের সম্মিলিত জিডিপির ১১ শতাংশের বেশি।
২০২১ সালের শুরুতে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বাজার মূলধন নিয়ে শীর্ষ অবস্থানে থাকা মাইক্রোসফটের বছর শেষে মূলধন ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। আর গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট বছর শুরু করেছিল ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন নিয়ে। যা বছর শেষে ২ ট্রিলিয়নের মাইলফলক স্পর্শ করে। করোনা মহামারির মধ্যে ঝড়ের বেগে বেড়ে ওঠা অ্যামাজন এর বাজার মূল্য এই বছরে তেমন বাড়েনি। বুধবার শেয়ারমূল্য পাঁচ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পেয়ে দিনশেষে অ্যাপলের বাজারমূল্য দাঁড়ায় দুই দশমিক ৩৭ ট্রিলিয়ন বা দুই লাখ ৩৭ হাজার কোটি ডলারে।
এর ফলে অ্যাপল অবস্থান হারায় সৌদি তেল ও গ্যাস উৎপাদক আরামকোর কাছে, যার বাজার মূল্য দুই লাখ ৪২ হাজার কোটি ডলার। ২০২০ সালের পর এই প্রথম আরামকো শীর্ষস্থানে পৌঁছালো। অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বছর পুঁজিবাজারে জ্বালানি উৎপাদকদের মূল্য বেড়েছে। এর মধ্যে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার চিত্রও এবার দ৩খারই মত। ২০২১ থেকেই মেটার খারাপ সময়ের সূচনা ঘটে। সম্প্রতি ফেসবুক মূল প্রতিষ্ঠান সেরা দশের তালিকা থেকে বাদ পড়ে ১১ নম্বরে চলে গিয়েছে। এক সময়ের ট্রিলিয়ন ডলারের এই কোম্পানিটির বর্তমান বাজার মূলধন নেমে গেছে ৫৬৫ বিলিয়ন ডলারে।
ফলে, শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকা থেকেও স্থান হারায় মার্ক জাকারবার্গের এই জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানটি। আর এই পরিস্থিতির জন্য মেটা নিজেই দ্বায়ী। ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়া ডেটা সংগ্রহসহ আরো অনেক ধরনের অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত থাকার ফলে ব্যবহারকারীরা ফেসবুকের প্রতি ক্ষুব্ধ। ফেসবুক অ্যালগরিদম নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদন গ্লোবাল উইটনেস প্রকাশ করে। উক্ত বিষয়টি একটি মানবাধিকার সংগঠনের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে উঠে এসেছিল। এ বিষয়েও ফেসবুক বরাবরই দাবি করে এসেছে, তাদের সিস্টেমগুলো ভুয়া তথ্যের প্রচারণা কমানোর লক্ষ্য নিয়েই নকশা করা হয়েছে।
বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে দরপতনের ফলে প্রায় ২০০ মিলিয়ন অ্যাক্টিভ ইউজারের সংখ্যা কমে যায়। গতমাসে ফেসবুক জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারকারীদের আরও উগ্রপন্থী ভুয়া তথ্য এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদী গ্রুপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে ফেসবুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ
শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই আমেরিকাভিত্তিক, অর্থাৎ মার্কিন আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হয়। অথচ, বিশ্বব্যাপী এর গ্রাহক ছড়িয়ে আছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ ধরে বর্তমানে অনেক মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান রাশিয়া সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থেকে দূরে রয়েছে। অর্থাৎ, আমেরিকা-ভিত্তিক হওয়াতে এসব প্রতিষ্ঠানে মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির একটা প্রভাব খুবই স্পষ্ট। এছাড়া, আমেরিকাবিরোধী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেও অনেক সময় এসব প্রতিষ্ঠানকে নিজ দেশে নিষিদ্ধ করে। স্বভাবতই আমেরিকা-বিদ্বেষী দেশগুলোতে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে।
চীন, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ইরানসহ বেশ কিছু দেশে মার্কিন অনেক প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখেছে। শুধু তাই নয়, এসব প্রতিষ্ঠানের বাজার বিশ্বব্যাপী, কিন্তু এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় মার্কিন আইন অনুযায়ী। তবে, বর্তমানে অনেক দেশ ও সংস্থা এই প্রযুক্তি কোম্পানি কার্যক্রম পরিচালনায় বেশ কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি তথ্যসূত্রে জানা যায় যে ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো মার্কিন প্রযুক্তি দানবদের ক্ষমতা রোধ করতে একক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন দেশের নির্বাচন, প্রচারণা, গোপন নথি ফাঁস, নজরদারি, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে শুরু করে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও কোনো না কোনো প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠান জড়িয়ে ছিল।
এসব কারণে বিভিন্ন দেশ ও সরকার এখন সাবধান রয়েছে। এছাড়াও নানা বিধি-নিষেধ চালু হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে।
প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিছু প্লাটফর্ম
এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে যাবে তা হয়তো কেউ আগে কল্পনাও করেনি। মানব ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই আবিষ্কারগুলো সমাজকে এভাবে বদলে দেবে তা হয়তো এর প্রতিষ্ঠাতারাও আগে কখনো ভাবেনি। তবে বেশ কিছু যোগাযোগ প্লাটফর্মগুলোতে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা সমাধান অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও অসম্ভব। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যসূত্র অনুযায়ী, 9/11 থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভুয়া খবরের প্রচারণা, কেলেঙ্কারি রটানো, মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা গুরুতর প্রভাব বিস্তার করছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ প্লাটফর্মগুলো।
এসব বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জটিল একটা কাজ। তাই ব্যবহারকারীরা তার ইচ্ছেমতো তথ্য প্রচার করতে এগুলো ব্যবহার করতে পারে। হ্যাকিং, বেনামে তথ্য প্রচার পুরোপুরি বন্ধ করার পদ্ধতি এখনো দেখা যায়নি। এর বাইরে ক্ষমতাসীন সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় স্বার্থ রক্ষায় মিথ্যা সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে জনগণের সম্মতি অর্জন করতে পারে। যা নির্বাচনের ফলাফলেও ভূমিকা রাখতে পারে। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধে চালানো প্রচারণা দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটা নেতিবাচক দিক আছে, তা হচ্ছে বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা।
উপসংহার
বিংশ শতাব্দির শুরুতে ডিজিটাল যুগের সূচনা ঘটে। মাত্র ২ দশকের ব্যবধানে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিপণ্য জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। যোগাযোগমাধ্যম কিংবা পণ্য কেনাবেচা, পরিবহণ কিংবা মহাকাশ অনুসন্ধান থেকে শুরু করে এসব প্রতিষ্ঠান এখন বিশ্ব রাজনীতির এক অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সমস্যা থাকলেও সুবিধা প্রয়োগে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে অস্বীকার যায় না। ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কল্যাণে মার্কিন ক্ষমতা এক নতুন রূপ লাভ করেছে। যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যাচ্ছে।
তাই, প্রতিটা রাষ্ট্রের জন্যে এদের প্রভাবে লাগাম টানতে স্বতন্ত্র আইন ও নীতিমালা থাকা জরুরি। এই প্রযুক্তির যুগে বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে হলে রাজনৈতিক অর্থনীতির শীর্ষে অবস্থান করতে হয়। যুক্তরাজ্যের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন কিংবা জেনারেল মটরস, চীনের পেট্রোলিয়াম সংস্থা বা জার্মানির অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের ওপর ভর করেই রাষ্ট্রগুলো বরাবর বিশ্ব রাজনীতিতে দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। রাষ্ট্র কিংবা প্রতিষ্ঠান এই রাজনৈতিক অর্থনীতির ভিত্তিতেই ক্ষমতার প্রান্তদ্বয় তৈরি করে।