Reading Time: 5 minutes

কোটি বছর আগের মহাকাশের চিত্র কেমন ছিল তা আমরা জানতাম না। এ মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র নক্ষত্র, ছায়াপথ কোটি বছর আগে কেমন দেখতে ছিল তা দেখার মত উপায় ও ছিল না। এই মহাকাশ টেলিস্কোপের বদৌলতে আমরা তা সম্ভব করতে পেরেছি। মহাবিশ্বে থাকা অজানা রহস্য উদঘাটনের রাস্তাও বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে এই মহাকাশ টেলিস্কোপের ফলে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে মহাজগতের অসংখ্য ছবি, যেখানে মহাকাশ ধরা দিয়েছে আদি চেহারায়, তা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা গহীন মহাশূন্যের ছবির অ্যালবাম নাসা প্রকাশ করার একদিন আগেই অ্যালবামের একটি ছবি হোয়াইট হাউজে দেখান। নাসার জেডব্লিউএসটি (জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ) ৪.৬ বিলিয়ন আগের গহীন মহাশূন্যের হাজারো ছায়াপথের ছবি তুলে পাঠিয়েছে। গহীন মহাশূন্যের ছায়পথগুচ্ছ এসএমএসিএস -০৭২৩ ৪.৬ বিলিয়ন আগে মহাশূন্য যেমন ছিল, ঠিক সেটিই উঠে এসেছে জেডব্লিউএসটি এর তোলা প্রথম ডিপ ফিল্ড ছবিতে।

এক হাজার কোটি ডলার খরচ করে বানানো টাইম মেশিনের সুবিধা প্রদানকারী এই টেলিস্কোপ জোতির্বিদদের লাখ লাখ বছর আগের মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণায় কাজটি আরও সহজ করে দেবে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এই মুহূর্তে বিশ্বের সর্বাধুনিক স্পেস অবজারভেটরি, যা বানাতে দুই দশকের মত সময় লেগেছে। প্রত্যাশা ছিল এই টেলিস্কোপ মহাবিশ্বকে দেখার ধারণাকে আমূল পাল্টে দেবে এবং হয়েছেও তাই। যুগান্তকারী প্রযুক্তি, নকশা এবং মহাকাশে এর অবস্থানের কারণে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এখন অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে রয়েছে অতি সূক্ষ্ম ক্যামেরা এবং স্পেকট্রোগ্রাফস, যা টেলিস্কোপটির সুবিশাল সোনার আয়না থেকে বিচ্ছুরিত আলো ধারণ করতে পারে। ১৯৯০ সালে চালু হওয়ার পর থেকে হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশে গ্রহ, ছায়াপথ এবং নীহারিকা ও নক্ষত্রের লাখ লাখ ছবি তুলেছে। দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া গ্রহাণু আর ধূমকেতুর ছবি তোলার সক্ষমতাও জেমস ওয়েবের আছে। ১২ জুলাই গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ শুরু করার আগে গ্রহাণুর ছবিও তুলেছে এ টেলিস্কোপ।

ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির সঙ্গে মিলে নাসা এই টেলিস্কোপটি বানিয়েছে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের কিছু বিশেষ দিক দ্য ন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

টেলিস্কোপটি যেভাবে মহাকাশে পৌঁছে

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ২০২১ সালের ক্রিসমাসের দিনে দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গুয়ানার কাছে এরিয়ান ৫ রকেটে করে মহাকাশের পথে উড়েছিল। একটি স্কুল বাসের সমান এই টেলিস্কোপের দৈর্ঘ্য ২১ মিটার ও প্রস্থ ১৪ দশমিক ৬ মিটার। ভাঁজ করার সুবিধা থাকায় রকেটে আঁটাতে এ টেলিস্কোপকে ভাঁজ করে নেওয়া হয়েছিল। সৌরজগতের বাইরে থাকা গ্রহগুলোর বার্তাবরণ নিয়ে গবেষণা করাই এ জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ বানানোর মূল উদ্দেশ্য।

অন্য ছায়াপথের গ্রহের যে বায়ুমণ্ডল, তাতে অক্সিজেনের উপস্থিতি খোঁজ করবে জেমস ওয়েব। হাবলকে যেভাবে মহাকাশে বসানো হয়েছে, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তার সঙ্গে মিল নেই। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মহাকাশের অনেক বাইরে এবং হাবল থেকে ভিন্ন এক কক্ষপথে বসানো হয়েছে, এতে করে অনেক দূরের বস্তুকণা দেখা সম্ভব।

অতিতের মহাকাশ চিত্র প্রদর্শন

বিগ ব্যাং থিওরি অনুসারে, মহাজগতের সূচনা হয়েছিল ১৩৮০ কোটি বছর আগে। নাসা গত ১২ জুলাই যে নীহারিকাপুঞ্জের ছবি প্রকাশ করেছে, তার নাম এসএমএসিএস ০৭২৩। এই নীহারিকাপুঞ্জের আলো পৌঁছাতে সময় লেগেছে ১৩০০ কোটি বছর। মহাবিশের কোটি কোটি বছর পূর্বের চিত্র কেমন ছিল তার স্পষ্ট ছবি দিতে পেরেছে এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপ ইনফ্রারেড আলো শনাক্ত করে, এর মধ্য দিয়ে সেটি মহাকাশে বস্তুকণার তাপের উৎস নির্ণয় করতে পারে।

এর ক্যামেরা এতটাই সূক্ষ্ম যে বাম্বল বা বড় আকারের মৌমাছির তাপ সংবেদনশীলতাও চিহ্নিত করতে পারে। হাবল টেলিস্কোপও এই গ্যালাক্সির ছবি আগে ধারণ করেছিল, কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের উজ্জ্বল ছবিতে বিবরণগুলো যেন বেশি স্পষ্ট।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

আয়না প্রতিফলন

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ১৮টি ষড়ভূজ আয়না বসানো হয়েছে, যা এক সাথে দেখতে মৌচাকের মত মনে হয়। টেলিস্কোপের আয়না থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে ক্যামেরায় আসে। আয়না যত কার্যকর হবে, অবজারভেটরির ক্যামেরা তত ভালো ছবি ধারণ করতে পারে। আয়নার ব্যাস ছয় দশমিক পাঁচ মিটার। আর এই আয়নার আকার হাবলের চেয়ে ছয়গুণ বড়; সেই সঙ্গে একশগুণ বেশি শক্তিশালী। ইনফ্রারেড আলোর প্রতিফলন যাতে ঠিক মত হয়, সেজন্য এ আয়নায় উপর পাতলা করে সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।

পৃথিবীর কক্ষপথে না বসে এই টেলিস্কোপ বসেছে সূর্যের কক্ষপথে। একই সঙ্গে এই টেলিস্কোপ রয়েছে পৃথিবী বরাবার, যদিও পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব হবে ১৫ লাখ কিলোমিটার এবং চাঁদের সাপেক্ষে চার গুণ দূরে। এই অবস্থানকে ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট বলে। সূর্যের উত্তাপ থেকে সুরক্ষা দিতে এই আয়নাকে রাখা হয় মাইনাস ২৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এ আয়নার উপর পাঁচটি স্তর রয়েছে, যা সূর্য থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে। টেনিস কোর্টের সমান এই স্তর সূর্যের উত্তাপকে লক্ষ ভাগে কমিয়ে দিতে পারে।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ হতে ধারণকৃত বৃহষ্পতি গ্রহের চিত্র

সম্প্রতি নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ) জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে তোলা বৃহস্পতি গ্রহের অবিশ্বাস্য কিছু ছবি প্রকাশ করেছে। এই টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা এসএমএসিএস ০৭২৩ নামের একটি নীহারিকাপুঞ্জের ছবি গত ১২ জুলাই হোয়াইট হাউজে প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর পর থেকে আরও ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে। তাতে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহটির বলয় ছাড়াও এর তিন চাঁদ- ইউরোপা, থিব ও মেটিস স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ

নাসার গবেষকগণ ওয়েবের যন্ত্রপাতি গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত কি না, তা যাচাই করতে ১২ জুলাইয়ের আগে তিনবার বৃহস্পতির ছবি তুলেছেন। সেই ছবিগুলো এখন প্রকাশ করা হচ্ছে স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট এর মিকালস্কি আর্কাইভ ফর স্পেস টেলিস্কোপে। স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষক ব্রায়ান হলার বলেছেন সেদিন প্রকাশ করা ডিপ ফিল্ড ছবি আর বৃহস্পতির নতুন ছবিগুলো মিলে ওয়েবের পূর্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছে।

বহু দূরের অস্পষ্ট ছায়াপথ থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের বৃহত্তম গ্রহের ছবি, যা কেউ চাইলে খালি চোখে নিজের উঠান থেকেই দেখতে পারেন। প্রথম ছবিতে বৃহস্পতিবার বলয় দেখা না গেলেও গ্রহের ইউরোপা চাঁদ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমনকি গ্রেট রেড স্পট নামে পরিচিত বৃহস্পতির পৃষ্ঠের দানবীয় ঝড়টিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বৃহস্পতির পাশেই ইউরোপা। বৃহস্পতির এই চাঁদ নিয়েও মহাকাশবিজ্ঞানীরা কৌতুহলী। তাদের ধারণা, উপগ্রহটির পুরু বরফের স্তরের নিচে একটি সাগর লুকিয়ে আছে।

বৃহস্পতি গ্রহের “গ্রেট রেড স্পট”

নাসা বলছে, বৃহস্পতি গ্রহের গ্রেট রেড স্পট নামক এই ঝড় এতোটাই বড় যে পুরো পৃথিবীকে গিলে খেতে পারবে। তবে ওয়েব টেলিস্কোপের নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা শর্ট-ওয়েভলেন্থ ফিল্টারের মাধ্যমে তোলা ছবিগুলোর প্রক্রিয়াজাত করার কৌশলের কারলে গ্রেট রেড স্পট লাল রঙের বদলে সাদা রঙে ফুটে উঠেছে। নাসার আসন্ন ‘ইউরোপা ক্লিপার’ মিশনের মূল লক্ষ্য বৃহস্পতির এই উপগ্রহ। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ছবিতে গ্রেট রেড স্পট এর পাশে ইউরোপার ছায়াও ধরা পড়েছে।

প্রথম ছবিটি বাদে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ইনফ্রারেড আলোর ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বৃহস্পতির ছবি নিতে আলাদা দুটি ফিল্টার ব্যবহার করেছে। নাসা দুই ফিল্টারে তোলা ছবি পাশাপাশি তুলনাও করেছে। ছবি দুটিতে বৃহস্পতির বলয়ের পাশাপাশি একই সঙ্গে ধরা পড়েছে বৃহস্পতির তিন চাঁদ। নিজেদের ওয়েবসাইটে নাসা বলেছে, এই ছবিগুলো প্রমাণ করছে, বৃহস্পতি, শনি এবং মঙ্গলের মত উজ্জ্বল গ্রহগুলোকে ঘিরে থাকা বলয় আর উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা আছে ওয়েব টেলিস্কোপের।

নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানী স্টেফানি মিলাম বলেন যে তার শুরুতে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সব কিছু এত স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল, আর কতটা উজ্জ্বল ছিল সবকিছু।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.