সিনেমার মত ওয়ার্মহোলে প্রবেশ কিংবা অতিক্রমের মাধ্যমে তার ওপাশে নতুন পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে এখনো কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। শুরু হয়নি মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে এখনো কোন অভিযান। বর্তমানে চাঁদে ফেরার কথা ভাবতেও এখনও অসংখ্য হিসেব তৈরি করতে হচ্ছে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের। তবুও থেমে নেই সৌরজগতের পৃথিবী নামক এই গ্রহ, মহামারীর প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে থাকা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে আবার মহাকাশ জয়ের লক্ষ্যে এগোনো শুরু করেছে পৃথিবী।
সব মিলিয়ে, মানবসভ্যতার মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে ২০২২ ছিল একটি ঘটনাবহুল বছর। এ বছরে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস টেলিস্কোপের তোলা ছবিতে পৃথিবীর জন্মের আগের মহাবিশ্ব দেখেছে মানবজাতি, চাঁদে নভোচারীদের ফেরানোর প্রতিশ্রতি নিয়ে উপগ্রহটিকে চক্কর দিয়ে পৃথিবীর পথ ধরেছে নাসার নতুন ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফট। অন্যদিকে, সবকিছু পার করে চীন মহাকাশে বানিয়ে নিয়েছে নিজেদের প্রথম স্পেসস্টেশন। ২০২২ বছরটিতে ঘটে যাওয়া মহাকাশযাত্রার বিশেষ অধ্যায়গুলো জেনে নেয়া যাক।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মহাকাশযাত্রা শুরু হয়েছিল গত বছরের বড় দিনে। কিন্তু এর সাড়া জাগানো, পত্রিকার পাতা ছাপানো ফল মিলেছে এ বছরই। জেমস ওয়েবের তোলা প্রথম ছবি নাসা প্রকাশ করেছে এ বছরের ১২ জুলাই। আর প্রথম ছবিতেই যেন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে স্পেস টেলিস্কোপটি। পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে আরও ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরের শীতল মহাকাশে একলা প্রহরীর মতো মহাবিশ্বের দিকে নজর রাখছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ বা জেডব্লিউএসটি।
ওয়েব টেলিস্কোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নাম বেশি শোনা গেলেও কৃতিত্ব কেবল মার্কিনিদের নয়। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অপটিকাল স্পেস টেলিস্কোপের নকশা, নির্মাণ ও উৎক্ষেপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ইএসএ এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি বা সিএসএ। টেলিস্কোপের সেন্সরে পাওয়া তথ্য শোনার উপযোগী অডিও ফাইলেও রূপান্তর করেছেন নাসার প্রকৌশলীরা। আর মহাবিশ্বের সেই আওয়াজকে ভৌতিক বললেও সম্ভবত ভুল বলা হবে না।
পৃথিবীর জন্মপূর্ব মহাবিশ্বের একটুকরা প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠেছে ওয়েবের প্রকাশিত প্রথম ছবিতে। তারপর থেকে একে একে পিলারস অফ ক্রিয়েশন, শনির চাঁদ টাইটানের মেঘ, দুই ছায়াপথের এক হয়ে যাওয়া, বৃহস্পতির অরোরার চোখ ধাঁধানো ছবি পাঠিয়ে মহাকাশ প্রেমীদের মাতিয়ে রেখেছে ওয়েব টেলিস্কোপ।
আর্টেমিস ওয়ান মিশন
টানা তিনবারের ব্যর্থতার পর অবশেষে ১৬ নভেম্বর আর্টেমিস ওয়ান মিশন উৎক্ষেপণ করেছে নাসা। প্রথম দুবার কারিগরি জটিলতার কারণে শেষ মুহূর্তে উৎক্ষেপণ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল নাসা। আর তৃতীয়বার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল আবহাওয়া। হিসেবে ১৬ নভেম্বরের উৎক্ষেপণ ছিল নাসার চতুর্থ চেষ্টা। সব জটিলতার সমাধান করে দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ উৎক্ষেপণের সবুজ সংকেত আসে নাসার কন্ট্রোল রুম থেকে। ৪০ মিনিট বিলম্বে ১২টা ৪৭ মিনিটে গর্জে ওঠে এসএলএসের রকেট ইঞ্জিন।
উৎক্ষেপণের দুই ঘণ্টার মাথায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার মাইলের বেশি উচ্চতায় চাঁদের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল আর্টেমিস ওয়ান মিশনের মূল স্পেসক্র্যাফট ওরিয়ন। পুরো মিশনের মূল লক্ষ্য দুটির মধ্যে প্রথমত, নিজেদের তৈরি স্পেস লঞ্চ সিস্টেম বা এসএলএস রকেটের কার্যক্ষমতা যাচাই করে দেখতে চায় নাসা। আর দ্বিতীয়ত, ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফট নভোচারীদের মহাকাশে আনা-নেওয়া করার জন্য নির্ভরযোগ্য কিনা, সেটিও পরীক্ষার বিষয়। ১১ ডিসেম্বর পৃথিবীতে ফেরার কথা রয়েছে ওরিয়নের।
নাসার এই ‘টু দ্য মুন অ্যান্ড বিয়ন্ড’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চাবিকাঠি হচ্ছে আর্টেমিস ওয়ান মিশনের এসএলএস রকেট আর ওরিয়ন মহাকাশযান। এ মিশনের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে নাসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। কারণ, এবার চন্দ্রজয়ের পরিকল্পনার পেছনে কোনো শীতল যুদ্ধের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নেই। বরং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। বয়স ফুরিয়ে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের আইএসএস।
তাই চাঁদে নতুন বাণিজ্যিক স্পেস স্টেশন ‘গেটওয়ে’ নির্মাণের কথা ভাবছে নাসা। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের সরকারি সংস্থা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোরও ‘গেটওয়ে’ ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। কেবল গেটওয়ে নয়, চাঁদে নভোচারীদের জন্য স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করতে চায় নাসা। আরও দূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হচ্ছে, গেইটওয়ে আর চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে মঙ্গল অভিযান পরিচালনা করা। মহাকাশ সংস্থাটি বলছে, এখন পর্যন্ত তাদের নির্মিত সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস রকেট
এসএলএস পুরোটাই কেবল একটি রকেট এমন নয়। রকেটের ২১২ ফুট উচ্চতার কোর স্টেজ বা মূল অংশের চারটি আরএস-২৫ ইঞ্জিন মাত্র আট মিনিটে ৭ লাখ ৩৩ হাজার গ্যালন প্রোপেল্যান্ট পুড়িয়ে ঘণ্টায় ১৭ হাজার মাইল গতি অর্জন করতে পারে বলে জানিয়েছে নাসা। সেই সাথে এসএলএসের কোর স্টেজ একা নয়। দু’পাশে আছে দুটি সলিড রকেট বুস্টার। উৎক্ষেপণের প্রথম দুই মিনিটে পুরো মহাকাশযানকে ওপরের দিক ঠেলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির ৭৫ শতাংশ আসবে দুই বুস্টার রকেট থেকে।
নাসা দাবি করছে, ৫৯ হাজার ৫২৫ পাউন্ডের বেশি ওজনের কার্গো দূর মহাকাশে পাঠানোর লক্ষ্য মাথায় রেখে নকশা করা হয়েছে এসএলএস রকেটের। আর রকেট থেকে আলাদা হওয়ার পর ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটকে চাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাবে ইন্টেরিম ক্র্যায়োজেনিক প্রোপালশন স্টেজ বা আইসিপিএস এর আলএল১০ ইঞ্জিন।
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন
২০১১ সালে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত তুলে আইন পাশ করে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আইএসএস এ চীনা নভোচারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করেছিল মার্কিন কংগ্রেস, যার ফলে চীন ক্ষুব্ধ হয়ে এক দশক পড়ে মহাকাশে নিজেদের স্পেস স্টেশন তিয়ানগং এর নির্মাণ কাজ শেষ করেছে চায়না ম্যানড স্পেস এজেন্সি বা সিএমএসএ। প্রথমে দুটি অস্থায়ী স্পেস স্টেশন তিয়ানগং-১ এবং তিয়ানগং-২ বানিয়ে নিজেদের দক্ষতা অর্জন করে নিয়েছিল চীনের সিএমএসএ।
এরপর ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিলে মডিউলার স্পেস স্টেশন তিয়ানগংয়ের প্রথম মডিউল তিয়ানহে মহাকাশে পাঠিয়েছিল চীনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। এর পরের দেড় বছরে একে একে মহাকাশে পৌঁছেছে তিয়ানগংয়ের বাকি মডিউলগুলো। চীন তিয়ানগংয়ের নকশা করেছে রাশিয়ার ‘মির’ স্পেস স্টেশনের নকশা অনুকরণ করে। ভূপৃষ্ঠের ৩৪০ কিলোমিটার থেকে ৪৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় ভেসে আছে স্পেস স্টেশনটি। এতো কম সময়ে মহাকাশে একটি দীর্ঘ মেয়াদী স্পেস স্টেশন নির্মাণ করে কার্যত বিশ্বকে চমকে দিয়েছে চীন।
মহাকাশে মানব জীবনধারণের খুঁটিনাটি আর অন্যান্য বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবটাই এখন নিজস্ব স্পেস স্টেশনে করতে পারবে চীন। ২৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো হাতবদল হয়েছে স্পেস স্টেশনটির নিয়ন্ত্রণ। শেষ পর্যায়ের নির্মাণকাজের দায়িত্ব থাকা নভোচারীদের কাছ থেকে তিয়ানগংয়ের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিয়েছেন নতুন তিন নভোচারী। আর এই ‘ক্রু হ্যান্ডওভার’ এর মধ্যে দিয়েই পুরোপুরি চালু হয়েছে তিয়ানগংয়ের কার্যক্রম।
পশ্চিমা প্রযুক্তি ও সহযোগিতার সক্ষমতা ছাড়াই মহাকাশে প্রথম স্পেস স্টেশন নির্মাণের কৃতিত্ব এখন চীনের, আর সেটি ঘটল এই ২০২২ সালেই।
ডার্ট মিশন
মানবসভ্যতার পরিণতি যেন জাদুঘরে শোভা পাওয়া ডায়নোসরের কঙ্কালের মতো না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে এ বছর ৬৮ লাখ মাইল দূরের ডাইমরফোস গ্রহাণুর দিকে ‘ডার্ট’ ছুড়ে দিয়েছিল নাসা। মহাকাশে ছুটে চলা কোনো গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার হুমকি তৈরি করলে, সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য মহাকাশযান দিয়ে কীভাবে ধাক্কা মেরে তার এর গতিপথ বদলে দেওয়া যায়, ডার্ট মিশন ছিল সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম পরীক্ষা। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছিল এক গ্রহাণু।
আর সে ঘটনার পার্শপ্রতিক্রিয়াতেই বিলুপ্ত হয়েছিল পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানোর ডায়নোসরেরা এমনটাই মত দিয়েছেন বেশিরভাগ বিজ্ঞানীগণ। ১১ হাজার সাতশ বছর আগে শেষ হওয়া বরফ যুগের পেছনেও উল্কাপাত বা গ্রহাণুর হাত ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। যদিও আগে থেকেই বড় বিতর্ক রয়েছে এই তত্ত্ব নিয়ে। উভয় তত্ত্বের কেন্দ্র রয়েছে একটি বিষয়, দূর মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা কিছু আছড়ে পড়ার কারণে বড় ক্ষতি হয়েছিল পৃথিবীর। আর সেই ঝুঁকি এখনও আছে।
ডার্ট ২৭ সেপ্টেম্বর ১৬০ মিটার চওড়া গ্রহাণুতে আঘাত হানার ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মহাকাশযানের গায়ে বসানো ক্যামেরা দিয়ে পুরো ঘটনা প্রবাহের ওপর নজর রেখেছিল নাসা। সফল হয়েছে সে মিশন। আবার কোনো গ্রহাণুর পৃথিবীর দিকে ঝাঁপ দেওয়ার খায়েস তৈরি হলে মানব সভ্যতার যে তাকে প্রতিহত করার নূন্যতম সক্ষমতাটুকু আছে, তা এখন বলাই যায়।