Reading Time: 5 minutes

গত বছর চীন তাদের মহাকাশ কেন্দ্রের প্রথম মডিউল কক্ষপথে স্থাপন করেছিল। যার নাম তিয়ানগং, বাংলায় যার মানে ‘স্বর্গের প্রাসাদ’। এতে আরও নতুন অংশ বা মডিউল যোগ করা চীনের এবারে পরিকল্পনায় রয়েছে। আর এই পরিকল্পনায় বৈজ্ঞানিক কাজের জন্য ল্যাব মেংতিয়ান এবছর শেষ হবার আগে যুক্ত হবে। তিনজন চীনা নভোচারী দেশটির নতুন মহাকাশ কেন্দ্রে কাজ করার জন্য ছয় মাসের এক মিশন শুরু করেছেন। সামনের কয়েক দশকের মধ্যেই শীর্ষ এক মহাকাশ পরাশক্তি হয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে এটি চীনের সর্বসাম্প্রতিক পদক্ষেপ।

মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে চীন বিশ্বের তৃতীয় দেশ যারা মহাকাশে নভোচারী পাঠিয়েছে এবং একই সঙ্গে মহাকাশে স্পেস স্টেশন বা মহাকাশ কেন্দ্র তৈরি করছে। এর আগে যে দুই দেশ এই দুটি উদ্যোগ নিয়েছিল তারা হল সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আগামী বছর চীন শুনতিয়ান নামে একটি মহাকাশ টেলিস্কোপ পাঠাবে। এটি মহাকাশ কেন্দ্রের কাছাকাছি দিয়ে উড়বে এবং কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ এবং কেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহের কাজ করবে। তিয়ানগং এ তাদের নিজস্ব বিদ্যুত ব্যবস্থা থাকবে, সাথে থাকবে কেন্দ্র চালনার প্রযুক্তি, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম এবং থাকার ঘর।

বর্তমানে যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএস (ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন) রয়েছে, চীনা নভোচারীদের সেটি ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। কারণ আমেরিকান আইনে এমন নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে যাতে নাসা তার কোন তথ্য চীনের সাথে শেয়ার করতে পারবে না। তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ নিয়ে চীনের পরিকল্পনা বর্তমানে আকাশচুম্বি। চীন আশা করছে বর্তমানে যে আইএসএস আছে, তাদের মহাকাশ কেন্দ্রটি ভবিষ্যতে তার জায়গা নেবে। আইএসএস-এর মেয়াদকাল ২০৩১ সালের দিকে শেষ হয়ে হয়ে যাবে, যখন সেটিকে অকার্যকর করে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নেয়া হবে।

চীনের মহাকাশ পরিকল্পনায় যা যা থাকছে

চীনের মহাকাশ পরিকল্পনা শুধু মহাকাশ কেন্দ্র তৈরিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখনকার সময় থেকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই চীন পৃথিবী পৃষ্ঠের কাছ থেকে গ্রহাণুর বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে চায়। চীনের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে তারা নভোচারী পাঠাবে এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহ থেকে নমুনা আনার জন্য তারা অনুসন্ধানমূলক মহাকাশ যান পাঠাবে। মহাকাশ অভিযান পরিকল্পনায় এবার চীন যা করতে যাচ্ছে-

  • ২০২২ সালে তিয়ানগং মহাকাশ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা।
  • ২০২৫ সালে পৃথিবী পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান থেকে গ্রহাণুর নমুনা সংগ্রহ করা।
  • ২০৩০ সালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহ থেকে নমুনা সংগ্রহের মিশন চালু করা, বৃহষ্পতি গ্রহে মানবহীন নভোযান প্রেরণ এবং চাঁদে নভোচারী প্রেরণ।
  • ২০৪০ সালে পারমাণবিক শক্তি চালিত মহাকাশ যান তৈরি করা।
  • ২০৪৫ সালে বিশ্বের শীর্ষ মহাকাশ শক্তি হয়ে ওঠা।

চীনের মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসসমূহ

১৯৭০ সালে চীন তাদের প্রথম স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ কক্ষপথে প্রেরণ করে। সেসময় শিল্প বিপ্লবের ফলে চীন ব্যাপক এক পরিবর্তনের ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। তখন মহাকাশ অভিযানে অংশ নিয়েছে কয়েকটি মাত্র দেশ, যার মধ্যে আমেরিকা, রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন), ফ্রান্স আর জাপান ছিল। নানা ক্ষেত্রে তখন ব্যাপক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে হচ্ছিল চীনকে। গত দশ বছরে চীন ২০০টির বেশি রকেট উৎক্ষেপণ করেছে। চীন ইতোমধ্যেই চাঁদে মানুষবিহীন নভোযান পাঠিয়েছে যার নাম চ্যাং ই ৫। এটি পাথরের নমুনা সংগ্রহ করেছিল। সেই সাথে চাঁদের পিঠে চীনা পতাকা স্থাপন করেছে।

যেটি ইচ্ছাকৃতভাবেই আগে চাঁদে তোলা আমেরিকান পতাকার চেয়ে বড় ছিল। তবে চীনের মহাকাশ অভিযান কর্মসূচিতে সম্প্রতি কিছু বিপর্যয় ঘটে। ২০২১ সালে চীনা রকেটের একটি অংশ কক্ষপথ থেকে মহাসাগরে ছিটকে পড়ে এবং ২০২০ সালে তাদের আরো দুটি উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হয়। শেনঝু ১৪ নভোযান পাঠানোর মাধ্যমে চীন এ পর্যন্ত ১৪জন নভোচারীকে মহাকাশে পাঠিয়েছে। তুলনামূলক হিসাবে আমেরিকা এ পর্যন্ত পাঠিয়েছে ৩৪০ জন নভোচারী আর রাশিয়া পাঠিয়েছে ১৩০ জনের বেশি নভোচারী।

যে কারনে চীন মহাকাশে যেতে আগ্রহী

চীন তার নিজস্ব স্যাটেলাইট প্রযুক্তি গড়ে তুলতে আগ্রহী টেলি যোগাযোগ, এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, চলাচল নির্দেশনা বা ন্যাভিগেশন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং অন্যান্য আরও কর্মকাণ্ডের জন্য। ব্রিটেনে পোটর্সমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাকাশ প্রকল্প পরিচালক লুসিন্ডা কিং বলছেন, চীন শুধু উচ্চ স্তরের বা প্রথম সারির মহাকাশ প্রযুক্তিতেই আগ্রহী নয়; বরং, মহাকাশের সব দিক নিয়ে তাদের আগ্রহ বিশাল। তাদের পেছনে রাজনৈতিক উৎসাহ রয়েছে এবং তাদের পরিকল্পিত কর্মসূচিতে অর্থায়নের জন্য সম্পদেরও অভাব নেই। চন্দ্রাভিযানে চীনের উৎসাহের আংশিক কারণ ছিল চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে বিরল পার্থিব ধাতু আহরণের সুযোগ সন্ধান।

তবে লন্ডন ইউনিভার্সিটির মহাকাশ নীতি বিষয়ক কেন্দ্র লন্ডন ইনস্টিটিউট অফ স্পেস পলিসি অ্যান্ড ল’র পরিচালক অধ্যাপক সাইদ মসতেশার বলছেন, তারা বারবার খনিজ পদার্থ সংগ্রহের মিশন চাঁদে পাঠানোর জন্য অর্থ ব্যয় করবে বলে মনে হয় না। তিনি বলছেন, চীনের মহাকাশ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হল তাদের উৎসাহ ও অর্জন দেখিয়ে সারা বিশ্বকে চমকে দেয়া। তাদের ক্ষমতার প্রদর্শন ও তাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে তুলে ধরাটাই প্রধান লক্ষ্য। তবে চীনের অনেক স্যাটেলাইট সামরিক উদ্দেশ্যেও মহাকাশ অভিযানে আগ্রহী। এসব উপগ্রহ ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর ওপর গোয়েন্দা নজরদারি করা যায়।

এগুলো দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার ক্ষেত্রে গতিপথ নির্দেশনাতেও সাহায্য করে।

মহাকাশ আইন সম্পর্কিত কিছু তথ্য

বিভিন্ন দেশ মহাকাশ অভিযানের পূর্বে কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলা আবশ্যক। মহাকাশ একটি স্বতন্ত্র এবং বিশাল একটি জায়গা যেখানে কোন নভোচারী কিংবা মহাকাশ অভিযান সংস্থা তার নিজস্ব সম্পদ বলে দাবি করতে পারবেনা। প্রত্যেক দেশ যেন শান্তিপূর্ণভাবে ঝামেলা ছাড়াই সফলভাবে মহাকাশ অভিযান চালাতে পারে সেজন্য জাতিসংঘ মহাকাশ আইন তৈরি করেছে। ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘ দ্বারা গঠিত মহাকাশ সম্পর্কিত চুক্তিতে বলা হয়েছে যে মহাকাশের কোন একটি স্থান কোন একটি দেশ নিজের বলে দাবি করতে পারবে না। ১৯৭৯ সালে প্রণীত চন্দ্র বিষয়ক চুক্তিতে বলা হয়েছে মহাকাশকে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না।

যদিও আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে। বর্তমানে আমেরিকা আর্টেমিস চুক্তি নামে তাদের একটি চুক্তিকে সামনে আনতে চাইছে, যাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিভিন্ন দেশ চাঁদের খনিজ সম্পদ কীভাবে সহযোগিতার ভিত্তিতে ব্যবহার করতে পারবে। রাশিয়া আর চীন এই চুক্তিতে সই করবে না। তাদের দাবি মহাকাশ নিয়ে আইন তৈরির অধিকার আমেরিকার নেই।

মহাকাশ অভিযানে অন্যান্য দেশ

চীন মহাকাশ অভিযানের পাশাপাশি চাঁদে যাবার লক্ষ্যে আরও কয়েকটি দেশ কাজ করে যাচ্ছে। রাশিয়া, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের নিজস্ব চন্দ্রাভিযানের কার্যক্রম নিয়ে কাজ করছে। নাসা আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশ থেকে নভোচারীদের আবার চাঁদে পাঠানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। নাসা চায় ২০২৫ সাল থেকে নভোচারীদের আবার চাঁদে পাঠানোর কার্যক্রম শুরু করতে এবং সে লক্ষ্যে কেনেডি স্পেস সেন্টারে তারা তাদের নতুন সুবিশাল এসএলএস রকেট বসিয়েছে। ভারত এগিয়ে রয়েছে এই অভিযানে।

ভারত ইতোমধ্যেই চাঁদে তাদের বড় দ্বিতীয় অভিযান চালিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতও তাদের নিজস্ব একটি মহাকাশ কেন্দ্র তৈরি করতে আগ্রহী। এদিকে চাঁদে অভিযান নিয়ে নাসার সঙ্গে কাজ করছে যে ইউরোপিয় মহাকাশ সংস্থা, তারাও চাঁদে স্যাটেলাইটের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে, যা নভোচারীদের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ সহজ করে দেবে।

মহাকাশ সম্পর্কিত কর্মকান্ডে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ব্যয় করছে

মহাকাশ প্রযুক্তিতে সরকারের ২০২১ সালের ব্যয়

দেশ

ব্যয় (বিলিয়ন ডলার)

যুক্তরাষ্ট্র

বিজ্ঞাপন (কেন?)

৫৪.৯

চীন

১০.৩

জাপান

৪.২

ফ্রান্স

৪.০

রাশিয়া

৩.৬

ইইউ

২.৬

জার্মানি

২.৪

চীনের মহাকাশ সম্পর্কিত কর্মকান্ডে ব্যয়ের উৎস

২০০৩ সালে চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসন গঠন করা হয়। প্রাথমিকভাবে তখন বাজেট বরাদ্দ ছিল ২০০কোটি ইউয়ান (৩০কোটি মার্কিন ডলার)। তবে ২০১৬ সালে চীন তার মহাকাশ খাতকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এই সংস্থাগুলো এখন প্রতিবছর এক হাজার কোটি ইউয়ানের বেশি (দেড়শ কোটি মার্কিন ডলার) মহাকাশ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করছে বলে জানাচ্ছে চীনা সংবাদ মাধ্যমগুলো। চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম শিনহুয়া বলছে চীনের মহাকাশ প্রকল্পগুলোতে কাজ করেছেন ৩ লাখ মানুষ। নাসায় বর্তমানে যত লোক কাজ করেন এই সংখ্যা তার ১৮ গুণ বেশি।

চীনের বাণিজ্যিক মহাকাশ খাতে এ যাবৎ এক শতাধিক মহাকাশ সংস্থা কাজ করছে। ২০২০ সালে ১০ বিলিয়ন ইউয়ানের বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে অর্থাৎ ১.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে পৃথিবীর কাছাকাছি কক্ষপথে প্রথম স্যাটেলাইট আই-স্পেস বাণিজ্যিকভাবে প্রেরণ করা হয়। এরপর ২০২১ সালে গ্যালাকটিক এনার্জি রকেট কক্ষপথে পাঁচটি স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.