Reading Time: 4 minutes

২০১৫ সালে প্যারিস প্রথম বারের মত জলবায়ু সম্মেলনেই বেশ ক’টি কোম্পানি স্পন্সর হিসাবে হাজির হয়েছিল। জলবায়ু সম্মেলনে বেসরকারি কোম্পানির আনাগোনা একেবারে নতুন কিছু নয়। কিন্তু গ্লাসগোতে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির উপস্থিতি এতটাই সরব ছিল যে তা নিয়ে বিশেষ করে দরিদ্র-অনুন্নত দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সন্দেহ-উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। যদিও জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের মুখ্য আয়োজক। কিন্তু গ্লাসগোর কপ সম্মেলন এবার মাইক্রোসফট, ইউনিলিভার, হিটাচি, গ্লাক্সো-স্মিথক্লাইন, জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার এবং আইকিয়ার মতো প্রায় ডজন খানেক করপোরেট জায়ান্ট স্পন্সর করছে। কপ মূল সম্মেলন ভবনের খুব কাছাকাছি ‘গ্রিন জোন’ নামে আলাদা একটি ভেন্যু তৈরি হয়েছে, যেখানে বেশ কিছু কোম্পানি যেগুলোর অধিকাংশই ব্রিটিশ।

তাদের উদ্ভাবিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর যানবাহন, যন্ত্রপাতি প্রদর্শন করছে। বিশ্ব নেতাদের শীর্ষ বৈঠকের সময় তাদের সাথে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জেফ বেজোস তার একটি ভাষণে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আফ্রিকায় জমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ বেজোস মহাকাশে পর্যটন ব্যবসার প্রতিযোগিতায় উঠে-পড়ে লাগা নিয়ে পরিবেশবাদীদের চাপের মুখে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে যে তিনি এমন সব মার্কিন রাজনীতিবিদদের চাঁদা দিয়েছেন যারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি স্বীকারই করেন না। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আসা পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী কেট রবিনসনের সাথে সম্মেলন কেন্দ্রে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন যে জাতিসংঘের একটি আয়োজন করপোরেট খাত দখল করে নিয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে।

জলবায়ু আলোচনায় কর্পোরেট খাতের এই সরব গতিবিধি সম্পর্কে তিনি খুবই বিরক্তবোধ করছেন। তার কাছে বিষয়টি বিস্ময়কর বলে মনে হচ্ছে। কেট রবিনসন আরও বলেন যে এমন সব কোম্পানি স্পন্সর হিসাবে হাজির হয়েছে যারা নিজেরাই তেল-গ্যাস ব্যবসার সাথে জড়িত। জেফ বেজোস বিশ্ব নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলছেন যেটা খুবই হাস্যকর তার কাছে। মূলত ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা কমানোর চেষ্টা এবং এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া বিপদ লাঘবের তহবিল আসবে। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং এশিয়ার অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো দাবি তুলেছে যে ২০৩০ সাল নাগাদ জলবায়ু সংকট নিরসনে বছরে তাদের জন্য ১,৩০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল করতে হবে।

পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বছরে তের শত না হয়ে ৩০০ বিলিয়ন হলেও তাতে ব্যবসার বড় সুযোগ পাচ্ছে। পশ্চিমা সরকারগুলোও যা চাচ্ছে সেটা সবাই বুঝতে পেরেছে, যদিও এই বিষয়টা গোপন রাখা হচ্ছে না। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারি প্রতিনিধিরা জলবায়ু তহবিল সম্পর্কিত মীমাংসা আলোচনাগুলোতে বেসরকারি খাতকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করার কথা বলছেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন যে ২০১৫ সাল থেকে জলবায়ু তহবিলে, জলবায়ু প্রকল্পে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তি নিয়ে যে কথা শুরু হয়, তা গ্লাসগোতে অনেক বেড়েছে। তিনি আরো বলেন যে তার মনে হচ্ছে যেসব কারণে গ্লাসগো সম্মেলন নিয়ে ভবিষ্যতে কথা হবে তার প্রধান একটি বিষয় হবে যে এখান থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতি-পরিকল্পনায় সাফল্যের সাথে বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঝড়-বন্যা প্রতিরোধে বাঁধ তৈরি, আর খরা-বন্যা-ভাঙ্গন-লবণাক্ততায় বাস্তচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন। জলবায়ু তহবিলে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছে এদেশগুলো, বিশেষ করে যারা জলবায়ুর পরিবর্তনের পরিণতিতে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে, দেশগুলো এটা ভেবে ভয় পাচ্ছে বেসরকারি খাত অতিরিক্ত সম্পৃক্ত হলে জলবায়ু মোকাবেলার কৌশলের অগ্রাধিকার বদলে যাবে। দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনে তাদের সক্ষমতা তৈরির চেয়ে গরীব দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ হ্রাসকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনার চেষ্টা হতে পারে। ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল স্টিল বিবিসিকে বলেন যে মিটিগেশন অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ কমানোর পেছনে পয়সা দেয়ার ব্যাপারেই পশ্চিমা দেশের আগ্রহ বেশি।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

কারন প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে এর ফলেই পশ্চিমা দেশের বেসরকারি খাত ব্যবসা পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে বছরে ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার তহবিলের কথা উঠছে। এটি ভবিষ্যতে একটি বড় ব্যবসার সুযোগ তৈরি করবে। এর সিংহভাগই আসলে খরচ হবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজে। উসুতু কামারা বলেন যে জলোচ্ছ্বাস এবং সাইক্লোনে তার দেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু অবকাঠামো এবং খোদ রাজধানী শহর চরম হুমকিতে পড়লেও এসব রক্ষার কাজে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে তেমন কোন টাকা তারা পাচ্ছেন না, বরং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে কাজ তাদের করতে হয়েছে। তিনি আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার অর্থ মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি হিসাবে গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি বিবিসিকে বলেন যে পরিমাণে যে টাকা দেওয়া হচ্ছে তা মূলত কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজে, কারণ তাতে হয়তো ব্যবসা হয়, মুনাফা হয়।

সে কারণেই ধনী দেশগুলোর এদিকে নজর দিচ্ছে বেশি। ড. আইনুন নিশাত মনে করেন যে জলবায়ু অর্থায়নে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়লে গরীব দেশগুলোতে বিপন্ন মানুষকে রক্ষার চেয়ে সেসব দেশের কার্বন নিঃসরণ কমানোকেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হতে পারে। কমপক্ষে তহবিলের ৫০ শতাংশ এমন সব প্রকল্পে দিতে হবে, যেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া থেকে মানুষজনকে বাঁচাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে তাদের সাহায্য করবে। এই বিষয়টির উপর বিবেচনা করে দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষ থেকে জোর দাবি তোলা হচ্ছে। ড. নিশাত আরো বলেন যে গ্লাসগোতে অর্থায়ন নিয়ে কিছু অগ্রগতি হতে পারে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ চায়। কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের আগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু অ্যাডাপটেশনে তাদের আগ্রহ থাকার কথা নয়। কারন মুনাফা ছাড়া বেসরকারি খাত এগোবে না।

বাস্তচ্যুত পরিবারের জন্য স্কুল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করে মুনাফা আসবে না। কার্বন নিরপেক্ষ প্রযুক্তি বিক্রি করলেই মুনাফা আসার সম্ভাবনা বেশি। উন্নত এবং অনুন্নত দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকার আওতা নিয়ে স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরার দাবি করছে। গ্লাসগোর কপ সম্মেলন কক্ষের বেশ কাছাকাছি ব্রিটিশ কিছু কোম্পানি নবায়নযোগ্য জ্বালানি চালিত নতুন কিছু প্রযুক্তি, পণ্য প্রদর্শন করছে। প্রদর্শনী রয়েছে সব দূষণমুক্ত প্রযুক্তি। সেখানে দোতলা যাত্রী বাস রাখা হয়েছে, যা ব্যাটারিতে চলে। ট্রাক্টর এবং রাস্তা খোঁড়ার ডিগার প্রদর্শিত হচ্ছে, যা ডিজেলের বদলে হাইড্রোজেনে চলবে। রোল রয়েসের উদ্ভাবিত এক আসনের বিমান দেখানো হচ্ছে যা ব্যাটারিতে চলে। নতুন এসব দুষণমুক্ত প্রযুক্তির যে আকাশছোঁয়া দাম তা অনেকদিন গরীব দেশগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে।

কিন্তু কার্বন নিঃসরণ কমানোর খাতে দেয়া তহবিলের বিপরীতে এমন সব প্রযুক্তি কেনার পরোক্ষ চাপ দরিদ্র দেশগুলোর ওপর তৈরি হতে পারে কিনা সে ভয় অমূলক নয়। কারণ, বৈদেশিক সাহায্যের সাথে বিভিন্ন শর্তের তালিকা পাওয়ার অভিজ্ঞতা এসব দেশের রয়েছে। সম্মেলনে তাদের বক্তব্যে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো জোর দিয়ে বলেছে যে তারা কার্বন নিরপেক্ষ প্রযুক্তি চায়, কিন্তু তা সহনীয় দামে হতে হবে এবং উন্নত দেশগুলো এই প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ভূমিকা বাড়লে সস্তায় প্রযুক্তি না পাওয়ার আশংকা রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.