Reading Time: 5 minutes

বর্তমানে প্রযুক্তি বাজারের জগতে ক্রিপ্টোমুদ্রা বিটকয়েন সম্পর্কে সবারই কম বেশি জানা আছে। ক্রিপ্টোমুদ্রা যেটি বর্তমানে ভবিষ্যৎ মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ভার্চুয়াল লেনদেনের ক্ষেত্রে একমাত্র সহজ মাধ্যম এই ডিজিটাল মুদ্রা। সাধারণ মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে বহুজাতিক লেনদেনগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে এরকমটা হয় না। স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন করা যায়। কোনো ব্যাংক, সরকার কিংবা কোনো কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক যে লেনদেন করবে, তার একটি রেকর্ড অনলাইন সার্ভারে থাকবে।

বিটকয়েন সম্পর্কিত কিছু তথ্য

পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত কম্পিউটারের মাধ্যমেই বিটকয়েনের সার্ভারের সাথে যুক্ত হতে পারেন। প্রতি দশ মিনিট পর পর মাইনারদের মাধ্যমে বিটকয়েন লেনদেনের রেকর্ড ‘ব্লক’ নামের গ্রুপে সংযুক্ত করা হয় এবং অসংখ্য ব্লককে একত্রে ব্লকচেইন বলা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, চাইলে ক্রিপ্টোকারেন্সির কোনো ইউনিটকে নগদ অর্থে রূপান্তরিত করা যায়। বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে যত বিটকয়েন রয়েছে, তার অর্থমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশে ইতোমধ্যে বিটকয়েনের ব্যবহার বৈধতা পেয়ে গিয়েছে।

বিটকয়েন ব্যবহারের একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে- যেহেতু এর মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই লেনদেনে একবার কোনোভাবে ভুল হয়ে গেলে সেটি সংশোধনের কোনো উপায় নেই। যদি কখনও ভুলবশত অচেনা কোন ব্যক্তির সাথে বিটকয়েনের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়, তাহলে সেই ভুল শোধরানোর কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে গ্রাহকদের সতর্ক থাকা জরুরি। বিটকয়েনের মাধ্যমে এখনো অনেক ধনী ব্যক্তিরাও স্বাচ্ছন্দে লেনদেন করে যাচ্ছেন। বিটকয়েন তৈরির পেছনে যে ক্রিপ্টোগ্রাফিক কোডিং পদ্ধতি রয়েছে, তার রহস্যভেদ করা প্রায় অসম্ভব।

মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির মাধ্যমে প্রণয়নকৃত এসএইচএ-২৫৬ অ্যালগরিদমের মাধ্যমে বিটকয়েনের ডিজাইন করা হয়েছে, নিরাপত্তার দিক থেকে যা অনন্য। তবে বেশ কয়েকবার বিটকয়েন কমিউনিটিতে হ্যাকিংয়ের ঘটনা সামনে আসলেও পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে- সেগুলো আসলে বিটকয়েন নেটওয়ার্ক নয়, বরং ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের ঘটনা ছিল।

বিটকয়েন উদ্ভাবনার পেছনে রয়েছে যে ব্যক্তি

হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট, তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দানিউব নদীর। সেই নদীর তীরে রহস্যজনক ব্রোঞ্জের একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে, যে মূর্তিটি মূলত একজন হুডি পরিহিত ব্যক্তির, যার হুডির একপাশে বিটকয়েনের একটি লোগো রয়েছে। রহস্যজনক এজন্য বলা হয়েছে কারন, প্রতিয়মাণ সেই মূর্তিটির মুখমন্ডলে কান ও চোখ বলতে কিছুই নেই। মূর্তির অবয়ব দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই প্রতিয়মাণ এই মূর্তির পেছনের মানুষটি আসলে কে। তবে মূর্তির মুখমণ্ডল খুব চমৎকারভাবে পালিশ হয়েছে যা দেখতে আয়নার মত স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার। এখন জানা যাক এই মূর্তির পেছনে থাকা রহস্যময়ী ব্যক্তির সম্পর্কে।

২০০৮ সালে যখন পুরো পৃথিবীতে অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যয়ের দিকে,  তখন ইন্টারনেটের প্রোগ্রামিং কমিউনিটিতে পিডিএফ আকারে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন ‘সাতোশি নাকামোতাে‘ ছদ্মনামের এক ব্যক্তি। সেই শ্বেতপত্রের শিরোনাম ছিল “বিটকয়েন: এ পিয়ার-টু-পিয়ার ইলেকট্রনিক ক্যাশ সিস্টেম” (Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System)। শ্বেতপত্রে যে ব্যক্তির নাম ছিল, অর্থাৎ সাতোশি নাকামোতো, তিনি কি একজন ব্যক্তি নাকি একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে তৈরি তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে এটা সবাই ধরে নিয়েছিল যে, ‘সাতোশি নাকামোতো’ একটি ছদ্মনাম, খোঁজ করলে এই নামে কাউকে পাওয়া যাবে না।

২০০৯ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে পরবর্তী দুই বছর বিভিন্ন অনলাইন ব্লগে সাতোশি নাকামোতো সক্রিয় ছিলেন এবং বিটকয়েনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে এসে তিনি বিটকয়েন কমিউনিটিতে ঘোষণা দেন, এখান থেকে সরে গিয়ে তিনি অন্য কোনো ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করবেন। তার প্রস্থানের পরও বিটকয়েনের গ্রহণযোগ্যতা কমেনি, বরং সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে বর্তমানে যত বিটকয়েন রয়েছে, তার পাঁচ শতাংশের মালিকানা এখনও সাতোশি নাকামোতোর হাতে, যার অর্থমূল্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।

সেই বিটকয়েন শিরোনামের সেই শ্বেতপত্রে বিটকয়েনের প্রকৃতি বা চরিত্র কেমন হবে, তা চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। তিনি দাবি করেছিলেন, গতানুগতিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর ভরসা রেখে যে নগদ অর্থের লেনদেন হয়, তাকে প্রতিস্থাপিত করতে বিটকয়েন হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এখানে লেনদেনের দুই পক্ষকে তৃতীয় কোনো পক্ষ (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) নিয়ে ভাবতে হবে না। এছাড়া এই ব্যবস্থায় যেহেতু ডিজিটাল মুদ্রাগুলো সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে তৈরি করা হবে, তাই নিরাপত্তা নিয়ে ব্যবহারকারীদের কোনো বাড়তি চিন্তার প্রয়োজন পড়বে না।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

এই পদ্ধতিতে লেনদেনের স্বচ্ছতা আনার জন্য বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠাতারা প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড যেসব সার্ভারে থাকে, সেসব সার্ভার একেবারে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালের শুরুর দিকে ইতিহাসের প্রথম বিটকয়েন ব্লক, যাকে ‘জেনেসিস ব্লক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সেটি ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করা হয়।

বিটকয়েন উদ্ভাবক হিসেবে দাবি করা ব্যক্তিবর্গ

বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু ব্যক্তি নিজেদের ‘সাতোশি নাকামোতো’ নিজেকে বিটকয়েন উদ্ভাবক সাতোশি নাকামোতো হিসেবে দাবি করে এসেছেন। তবে তাদের দাবিগুলো পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে সত্য বুএ প্রমাণিত হয়নি। গণমাধ্যমগুলো প্রায় সময়ই সাতোশি নাকামোতোকে নিয়ে জনগণের বিপুল আগ্রহের ফায়দা তোলার জন্য বেশ কিছু ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে, তবে সব চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। বিখ্যাত গণমাধ্যম নিউজউইক জাপানি-বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক দোরিয়ান নাকামোতোকে বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবি করেছিল। 

পরবর্তীতে তিনি সেই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। ‘হ্যাল ফিনলে’ নামের এক প্রোগ্রামার ও বিটকয়েনের প্রথমদিকের একজন ব্যবহারকারীকে ‘সাতোশি নাকামোতো’ হিসেবে দাবি করা হয়েছিল। দোরিয়ানের মতো তিনিও এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন। কম্পিউটার বিজ্ঞানী নিক জ্যাবোকেও একসময় দাবি করা হয়েছিল সাতােশি নাকামোতো হিসেবে, কিন্তু তিনিও দিনশেষে বাকিদের মতো সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে একজন ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ক্রেইগ রাইট নামের এক অস্ট্রেলিয়ান উদ্যোক্তা নিজেকে সাতোশি নাকামোতো হিসেবে দাবি করেন।

মার্কিন কপিরাইট অফিসে রীতিমতো ২০০৮ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত শ্বেতপত্র নিয়েও হাজির হন কপিরাইট নিজের নামে করে নেয়ার জন্য। তবে তিনি সত্যিকারের সাতোশি নাকামোতো কিনা, তা নিয়ে বিটকয়েন কমিউনিটিতে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

আজও উদঘাটন হয়নি বিটকয়েন উদ্ভাবক রহস্য

বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে কঅতগুলো বছর। এর মধ্যে অসংখ্য পরিবর্তন এসেছে, বিটকয়েন একেবারে অপরিচিত একটি বিষয় থেকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, এমনকি এটা নিয়ে ইন্টারনেট জগতে তো বটেই, মার্কিন আদালতেও বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামের পেছনে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সন্ধান না পাওয়াটা একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট জগতের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর একটি হয়েই থাকবে। একজন মানুষের তৈরি একটি ভার্চুয়াল লেনদেন ব্যবস্থা এক যুগের মধ্যেই শক্ত ভিত্তি পেয়ে গিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে কিংবা এক দেশ থেকে আরেক দেশে অর্থ লেনদেন করা সম্ভব হয়েছে যার কল্যাণে, বিশ্বব্যপী প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থাকে এক ধাক্কায় এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন যিনি, তাকে এখনো কেউ চেনে না, কেউ তার পরিচয় জানে না। বিষয়টি অদ্ভুত হলেও সত্যি। বর্তমানে মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে যতটাই গুটিয়ে থাকুক না কেন, নানা কারণে তাদের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে চলাফেরা করতে হয়। এরকম একটা সময়েও যে একজন ব্যক্তি নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় লুকিয়ে রেখে আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে চলেছেন, বিশ্বব্যাপী এক উদ্ভাবনী মুদ্রাব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা হয়েও সফলভাবে নিজেকে আড়ালে রাখতে পেরেছেন এটি সত্যিই অনেক গম্ভীর একটি বিষয়।

বিভিন্ন ব্যক্তি নিজের ব্যবসায়িক সুবিধা, জনপ্রিয়তা পেতে নিজেদের বিটকয়েন উদ্ভাবক হিসেবে দাবি করে আসলেও যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে তার কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর বড় বিষয় সাতোশি নাকামোতো নামের পেছনে যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন, তারা কেনই বা নিজেদের আড়ালে রেখে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে এই প্রশ্ন এখনো থেকেই যাচ্ছে। 

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.