Reading Time: 4 minutes

বর্তমান সময়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টিকারী মুখ লামীয়া আশরাফ মওলা। ২০২০ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করা লামীয়া এখন ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোর ডানলাপ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রেনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এ পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। তিনি কাজের সুবাদেই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্পে হাজার বিজ্ঞানীর দলে যুক্ত হয়েছেন। বিজ্ঞানপ্রেমী, কিশোর-তরুণ-জ্যেষ্ঠদের হাজারো প্রশ্ন আর শতশত কৌতূহলের মধ্যে জেমস ওয়েবের যুগান্তকারী ছবির ঝলকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

তার অবাক করা প্রকল্পে মুগ্ধ হয়ে বিশ্ব জুড়ে এখন হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে, সেই সাথে আসছে অসংখ্য অভিবাদন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস স্যাটেলাইটের তোলা গহীন মহাশূন্যের ছবির অ্যালবাম প্রকাশ করার একদিন আগেই অ্যালবামের একটি ছবি হোয়াইট হাউজে দেখান। নাসার জেডব্লিউএসটি (জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ) ৪.৬ বিলিয়ন আগের গহীন মহাশূন্যের হাজারো ছায়াপথের ছবি তুলে পাঠিয়েছে।

গহীন মহাশূন্যের ছায়পথগুচ্ছ এসএমএসিএস -৭২৩ ৪.৬ বিলিয়ন আগে মহাশূন্য যেমন ছিল, ঠিক সেটিই উঠে এসেছে জেডব্লিউএসটি এর তোলা প্রথম ডিপ ফিল্ড ছবিতে। সোমবারেই এক হাজার কোটি ডলারের বেশি খরচে নির্মিত জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের প্রথম ছবিগুলো নাসা প্রকাশ করেছে। ওয়েব যে ইনফ্রারেড তরঙ্গের ছবি তুলেছে তা হাবল টেলিস্কোপের ক্ষমতার অনেক বাইরে। বিভিন্ন ইনফ্রারেড তরঙ্গের এমন একটি ছবি তুলতে হাবল টেলিস্কোপের কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতো বলে নাসা জানিয়েছে।

যার ফলে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস টেলিস্কোপটি নাসার হাবল টেলিস্কোপকে প্রতিস্থাপন করবে, এমন গুঞ্জন রয়েছে বাজারে। তবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্পে কাজ করা বাংলাদেশের উজ্জ্বল মুখ বিজ্ঞানী লামীয়া আশরাফ মওলা বলছেন, হাবল এখনও গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল আকারের গ্যালাক্সিগুলোর বিবর্তন আর কাঠামো পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা চালানো লামীয়া বলছেন, বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, কারিগরি গঠন বিবেচনায় নিলে টেলিস্কোপ দুটি একেবারেই ভিন্ন, সেই সাথে পার্থক্য আছে অবস্থানেও।

হাবল মানব চোখে দৃশ্যমান আলোক রশ্মিতেই মহাবিশ্ব দেখে। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মূলত ইনফ্রারেড টেলস্কোপ, সাধারণ পরিস্থিতিতে আলোর তরঙ্গের যে অংশটুকু মানব চোখে দৃশ্যমান নয়, তার ভিত্তিতেই মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে নাসার নতুন টেলিস্কোপটি। উভয় টেলিস্কোপের মূল কাজ মহাবিশ্বের দিকে রাখা হলেও, টেলিস্কোপ দুটি মহাকাশকে পর্যবেক্ষণ করছে কার্যত ভিন্ন দৃষ্টি কোণ থেকে। দুই টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ থেকে আসা ডেটাতেও আছে বড় পার্থক্য।

হাবলের আয়না আকারে ২.৪ মিটার; এর বিপরীতে ওয়েব টেলিস্কোপের আয়নার আকার ৬.৬ মিটার। অর্থাৎ, হাবলের চেয়ে ওয়েবের আলোকরশ্মি গ্রহণ করার সক্ষমতা বেশি। কিন্তু, দুটি টেলিস্কোপের মধ্যে তুলনা বিচার ঠিক যৌক্তিক নয় বলেই ফোর্বস সাময়িকীকে বলেছেন লামীয়া।

হাবলের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা ওয়েবের চেয়েও বেশি

সক্ষমতার বিচারে ওয়েব বেশি শক্তিশালী, তাই বিজ্ঞানীদের কাছেও এ মুহুর্তে এর চাহিদা বেশি। ওয়েবের উপস্থিতিতে হাবলের সময় নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে চাহিদা একটু কমলেও পুরনো টেপলিস্কোপটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে ভাবলে ভুল হবে। বিজ্ঞানী লামীয়ার নিজের গবেষণা প্রকল্প ‘থ্রিডি-ড্যাশ’ এর অংশ হিসেবে ইনফ্রারেডের কাছাকাছি তরঙ্গে মহাকাশের ছায়াপথগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হাবল টেলিস্কোপের সময় লেগেছে আড়াইশ ঘণ্টা।

তিনি ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোর ডানল্যাপ ইনস্টিটিউট ফল অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। এছাড়াও তিনি জেডব্লিউএসটির একাধিক দলের সদস্যও। গেল মাসেই ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল’ এ প্রকাশিত হয়েছে থ্রিডি-ড্যাশ নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন, আর তার সহ-রচয়িতা ছিলেন লামীয়া। মহাকাশের যে অংশগুলোতে নতুন নক্ষত্রের গঠন হচ্ছে, ‘থ্রিডি-ড্যাশ’ কে লামীয়া তার ম্যাপ বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

এর মাধ্যমে মহাকাশের বিরল বস্তুগুলোর খোঁজ করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা, এরপর ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে আরও খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণও সম্ভব হবে। বিজ্ঞানী লামীয়া বলেন এই ছবিটি ওয়েবের জন্য গুপ্তধনের অগভীর ম্যাপ হিসেবে কাজ করবে যার মাধ্যমে টেলিস্কোপটি ফেরত যেতে পারবে এমন নতুন লক্ষ্য খুঁজে নিয়ে তার গভীরে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। তিনি আরো বলেন থ্রিডি-ড্যাশ প্রোগ্রাম হাবলের মহাকাশের বড় একটা অংশে ছবি তোলার সক্ষমতার ঐতিহ্যকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

যেন তারা ছায়াপথের বাইরে ছায়াপথগুলোর রহস্য উদঘাটন শুরু করতে পারেন। তবে ওয়েব হাবলের চেয়ে বেশি হাই-রেজুলিউশনের ছবি ধারণে সক্ষম এবং ইনফ্রারেড আলোর প্রতি প্রায় ১০ গুণ বেশি স্পর্শকাতর বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানী লামীয়া। তিনি বলেন হাবল এতোদিন যা করে এসেছে ওয়েব সেই কাজ আরও বেশি সময় ধরে আরও দ্রুত করতে পারে। রেজুলিউশেনর বেলায় স্পিটজারের চেয়ে ওয়েবের সক্ষমতা এতো বেশি যে বিষয়টি অনুধাবন করা কঠিন বলে জানিয়েছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

আকাশের ঘোলাটে অংশ হিসেবে আমরা এতোদিন যা দেখতে পেতাম সেগুলো এখন স্পষ্ট ছায়াপথ হিসেবেই দেখা যাবে বলেন তিনি। ওয়েবের মাধ্যমে কেবল হাজার কোটি বছর আগের ছায়াপথগুলোই স্পষ্ট হয়ে উঠবে, এমনটা নয়, ছায়াপথের গহীনের খুঁটিনাটি বৈশিষ্টও উঠে আসবে টেলিস্কোপের ছবিতে। তবে, ওয়েব এক্ষেত্রে হাবলের উত্তরসূরী নয় বা হাবলকে প্রতিস্থাপন করবে না। বরং নাসার স্পিটজার স্পেস টেলিস্কোপের জায়গা নিচ্ছে ওয়েব টেলিস্কোপ।

২০০৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কক্ষপথে থাকলেও স্পিটজারের প্রপেল্যান্ট ফুরিয়ে গেছে।

হাবল ও ওয়েবের পার্থক্য

হাবল পৃথিবীর চারপাশ ঘুরে আসে বলে টেলস্কোপটিতে গিয়ে ছোটখাটো সারাই বা আপগ্রেডের কাজ করতে পেরেছিলেন নাসার নভোচারীরা। তবে ওয়েবের বেলায় সেই সুযোগ নেই। মহাকাশে ওয়েবের অবস্থান লাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট ২-এ, পৃথিবীতে থেকে যার দূরত্ব ১৫ লাখ কিলোমিটার। টেলেস্কোপটি যেন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মাইনাস ৩৮৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ২৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সামান্যতম তাপের চিহ্নও ধরতে পারে সে জন্যই পৃথিবী থেকে এতো দূরে ওয়েব টেলিস্কোপ।

ফলে, কারিগরি কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে নাসার নভোচারীরা গিয়ে তার সমাধান করে দিয়ে আসবেন এমন সুযোগ নেই বললেই চলে। হাবল অতিবেগুণী রশ্মি এবং মানব চোখে দৃশ্যমান আলোতে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করলেও, দীর্ঘ ইনফ্রারেড তরঙ্গে ছবি তোলে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। মূল পার্থক্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি যা হাবলকে প্রাসঙ্গিক রাখবে, সেটি হলো হাবল আল্ট্রাভায়োলেট থেকে নিয়ার ইনফ্রারেড আলো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে পারে।

আর ওয়েব নিয়ার ইনফ্রারেড থেকে ইনফ্রারেড তরঙ্গের মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। এর মানে ওয়েব অতিবেগুনী এবং দৃশ্যমান আলো পর্যবেক্ষণ করে না। কেউ যদি অতিবেগুনী রশ্মি আর দৃশ্যমান আলোতে কিছু পর্যবেক্ষণ করতে চান, তবে সেটি অর্জন করতে হাবলের কাছেই ফেরত যেতে হবে বলে তিনি জানান।

হাবল এখনও গুরুত্বপূর্ণ

ওয়েবের উপস্থিতি আর সক্ষমতা কারণে প্রশ্ন উঠতেই পারে, হাবল কি এখনও প্রয়োজন কি না। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানী লামীয়ার উত্তর হ্যাঁ। ওয়েবের মাধ্যমে নতুন অনেক কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব যা আগে চিহ্নিত করা হয়নি। হাবলের মাধ্যমে সেখানে ফেরত গিয়ে আবার দেখার চেষ্টা করা হবে, হয়তো আরও বেশি সময় নিয়ে আরও গহীনে। সুতরাং, ওয়েবের পাশাপাশি হাবলের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। নতুন পর্যবেক্ষণে হাবল গুরুত্বপূর্ণ হয়েই থাকবে। ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাবিশ্বের যে ছবিগুলো তোলা সম্ভব হবে তার সবগুলোই নির্ভর করবে হাবল থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর। 

হাবলের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই আমাদের সবগুলো লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে– আর ওয়েব এখন এতে আরও বেশি তথ্য যোগ করবে। হাবল এখানে খুবই, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহাবিশ্বের তুলনামূলক নতুন অংশগুলো পর্যবেক্ষণেই অতিবেগুনী রশ্মি আর দৃশ্যমান আলো প্রাসঙ্গিকতা বলে জানিয়েছেন তিনি। নির্দিষ্ট কোনো ছায়পথের নতুন যে নক্ষত্রগুলো ছোট ওয়েভলেন্থে খুবই উজ্জ্বল আলো ছড়ায়। তাই সার্বিক দৃশ্যপট বুঝতে আলোর সার্বিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যে মহাবিশ্বের নতুন ও পুরনো উভয় অংশের ডেটা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।

এতে মহাবিশ্বের ‘ইতিহাস ও বর্তমান পর্যবেক্ষণ করে’ ভবিষ্যতের দৃশ্যপট চিত্রায়ন সম্ভব হবে বলে মন্তব্য তার।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.