Reading Time: 5 minutes

মহামারীর বছরগুলোতে বাইরের কর্মহীন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তি সামগ্রী ও সেবা একটি বিশাল অবদান হিসেবে ছিল। পেশাহীন, ঘরবন্দী মানুষের আয়ের উৎসসহ দরকারী জিনিসের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ছিল প্রযুক্তি। এছাড়াও লকডাউনে ঘরবন্দী মানুষের বিনোদনের চাহিদা, দূরদুরান্তের মানুষের সাথে প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্য সুযোগ করে দিয়েছে এই প্রযুক্তি। মানুষের সাফল্যের পেছনে প্রযুক্তির এরকম আরো অনেক অবদান যা বুএ শেষ করা যাবে না। তবে সবসময়ই যে প্রযুক্তি মানুষের জীবনে সফলতা বয়ে এনেছে তা নয়।

সফলতার পাশাপাশি মানুষের ইন্টারনেট ত্রুটি, সুংযোগ ত্রুটি, ডেটা চুরির মত নানা রকম প্রযুক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর্টিকেলটিতে বছর জুড়ে নানা খাতে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান আর সেবা বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা যাক।

ফেসবুকের ডেটা চুরি ও ফাঁস

ফেসবুক জনপ্রিয় এবং বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি পেলেও এর ভয়ঙ্কর দিকের কথা প্রায় সব ব্যবহারকারীদেরই জানা। অনুমতি এবং ইঙ্গিত ছাড়াই গোপনে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরির পাশাপাশি সেগুলো তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার মত জঘন্য কাজ ফেসবুক (বর্তমানে মেটা) শুরু থেকেই করে আসছে। এপ্রিল মাসে সাইবার নিরাপত্তা গবেষকরা জানান যে হ্যাকারদের কাছে জনপ্রিয় একটি ওয়েবসাইটে ৫০ কোটি ফেইসবুক ব্যবহারকারীর ফোন নম্বর, জন্মদিন আর ইমেইল ঠিকানার মতো নানা ব্যক্তিগত ও গোপন তথ্য পাওয়া গিয়েছে। যা ফেসবুক নিজেই এর সাথে জড়িত ছিল।

তবে ফেসবুক দাবি করেছিল যে সাইবার অপরাধীরা ২০১৯ সালে ওই একই ডেটা হাতিয়ে নিয়েছিল এবং সে বিষয়ে যথাযথ নিরাপত্তা ত্রুটি ও যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে উক্ত বছরেই তা সমাধান করা হয়েছিল। সিএনএন বলছে যে সেবাগ্রাহকদের ডেটা সংগ্রহ করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো যে সাইবার অপরাধীদের সামনে কতোটা দুর্বল সেই বিষয়টি উক্ত ঘটনা দ্বারাই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

সমালোচনার মুখে পড়ে ফেসবুক

ফেসবুকের একেকটি কূকর্ম ফাঁস হওয়ার পর থেকে পুরো বছর ফেসবুকের প্রায়ই বাজে সময় যাচ্ছিল। যদিও ফেসবুক তাতে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকের সাবেক এক কর্মী প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার কূকর্ম এবং কর্মীদের নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটি গোপন তথ্য ফাঁস করে। এছাড়াও ভ্যাক্সিন সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্য, রোহিঙ্গা বিদ্বেষ ছড়ানোতে ফেসবুকের প্রশ্রয়ের কথা সবার সামনে তুলে ধরা হয়। ফেসবুকের উক্ত সাবেক কর্মীর কাছ থেকে পাওয়া ফেসবুকের গোপন নথিপত্র বিশ্লেষণ করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ফেসবুক ফাইলস নামের সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছিল।

ফেসবুকের কূকর্ম ফাঁস হবার পর ৪ই অক্টোবর ফেসবুক সবকিছু থেকে বেশ কয়েক ঘন্টার জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফেসবুকের পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম ও বিচ্ছিন্ন হয়ে ফেসবুক দাবি করে যে কনফিগারেশন পরিবর্তনের কারনে ফেসবুক কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকেই ফেসবুক কঠোর সমালোচনা ও চাপের সম্মুখীন হয়েছে। ডেটা চুরি এবং ব্যবহারকারীর চুরিকৃত ডেটা সমূহ তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রির জন্য বড় বড় হ্যাকিং কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এরকম অবৈধ কাজের ফলে ফেসবুক ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।

বিভিন্ন অভিযোগ আসা সত্ত্বেও ফেসবুক প্রতিষ্ঠান পুরো বিষয়গুলো এখনো নজর আন্দাজ করে যাচ্ছে। সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখন অব্দি কোন সমাধান পাওয়া যায়নি। মোটকথা, ফেসবুকের মূল লক্ষ্য ব্যবহারকারীদের ডেটাসমূহ তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করে মোটা অংকের মুনাফা অর্জন করা।

লিংকডইন ডেটা চুরি ও ফাঁস

ফেসবুকের ডেটা হ্যাকের সাথে একই সময়ে লিংকডইনের তথ্য চুরির খবর প্রকাশ হয়। লিংকডইন জানায় যে ৫০ কোটি ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট জনসাধারণের জন্য হ্যাকাররা উন্মুক্ত তথ্য সংগ্রহ করে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি করছে। ওই সময় লিংকডইন দাবি করেছিল যে বিক্রির জন্য ওঠা ডেটাবেজটি আসলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা তথ্যসমূহ। লিংকডইন প্রতিষ্ঠানে কোন তথ্য আসলে ফাঁস হয়নি বলে দাবি করে।

র‍্যানসমওয়্যার

২০২১ সালে র‍্যানসমওয়্যারের আক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই ধরনের সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে হ্যাকাররা সাথারণত কম্পিউটার সিস্টেমকে সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। হ্যাকাররা প্রতিষ্ঠানের স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ কম্পিউটার ব্যবস্থা জিম্মি করে রেখে বড় অংকের মুক্তিপণ দাবি করে থাকে। জুন মাসে মার্কিন তদন্তকারী ও বিচার বিভাগ জানায় তারা হ্যাকারদের কাছ থেকে ২৩ লাখ ডলার সমমূল্যের ক্রিপ্টোকারেন্সি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। সাইবার আক্রমণগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিয়াল পাইপলাইনের উপর আক্রমণ বছরের সবচেয়ে বড় র‌্যানসমওয়্যার আক্রমণগুলোর একটি ছিল।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

এরপরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুনরায় চালু করার জন্য ৪৪ লাখ ডলার মুক্তিপণ দিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। আক্রমণের ফলে কলোনিয়াল পাইপলানে কর্মকান্ড সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

টেসলার ফুল সেল্ফ ড্রাইভিং ত্রুটি

টেসলা প্রধান ইলন মাস্ক বেশ সময় ধরেই নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের ফুল সেলফ-ড্রাইভিং (এফএসডি) সফটওয়্যারের গুণ গেয়ে আসছেন। তবে ২০২১ এর শেষে এসেও এখনো সফটওয়্যারটি স্বনিয়ন্ত্রিত হতে পারেনি। সফটওয়্যারটিতে শুধুমাত্র চালককে সহযোগিতা করার জন্য কিছু উপযোগী ফিচার দেওয়া হয়েছে। সফটওয়্যারের সাহায্য নেয়া সত্ত্বেও যে কোনো সময়ে ড্রাইভিং হুইলের নিয়ন্ত্রণ নিতে চালককেই প্রস্তুত থাকতে হয়। ক্রেতারা বলছেন যে তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক গ্রাহকেরা উক্ত ফিচার ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১০হাজার টেসলা মালিক বিপুর পরিমাণে অর্থ খরচ করে ফিচারটির বেটা সংস্করণ ব্যবহার করেছেন।

সিএনএনকে একাধিক চালক সফটওয়্যারটি নিয়ে সমস্যার কথাগুলো তুলে ধরেন। সিএনএন চালকদের অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছেন। এফএসডি ফিচারটি চালু থাকলে গাড়িটি কখন কী করে বসবে চালকেরা সেই ভয়ে থাকেন। সাংবাদিকরা টেসলার মডেল ৩ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন। গাড়িটি ইয়র্কের রাস্তায় এক সাইকেল চালককে এড়াতে গিয়ে ইউপিএস ট্রাকের ওপর সজোরে আছড়ে পড়তে যাচ্ছিল। এ ছাড়াও টেসলা মডেল ৩ এর এফএসডি রাস্তার উল্টো পাশে চলে যাওয়ার চেষ্টাও করেছে।

ভুল অপরাধী শনাক্তে সিটিজেন এর অ্যাপ

কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান সিটিজেন এর নির্মিত অ্যাপ। প্রতিষ্ঠানটি লস অ্যাঞ্জেলসে দাবানলের পেছনের মূল হোতাকে চিহ্নিত করতে সহযোগিতা করে এবং বিনিময়ে ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল। স্থানীয় পুলিশ ব্যবহারকারীদের দেওয়া তথ্য আর ছবির ভিত্তিতে এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছিল। পুরো ঘটনায় জটিলতা ছিল একটাই, সন্দেহভাজন সেই ব্যক্তিকে ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। অর্থাৎ সিটিজেন এর অ্যাপ ভুল মানুষকে অগ্নিসংযোগের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

সন্দেহভাজন ব্যক্তির তথ্য প্রচার করতে প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব অ্যাপের অনএয়ার নামের নতুন একটি সেবা ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সেবাটি তথ্য প্রচারের আগে নিজস্ব নিশ্চিতকরণ করতে পারেনি।

ইন্টারনেট সংযোগে ত্রুটি

এই বছরে বিশ্বের সকল ইন্টারনেট সংযোগ দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে দুইবার বিভ্রাটের কবলে পড়েছিল। ৮ জুন কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক ফাস্টলি এর ত্রুটির ফলে ইন্টারনেটে সিএনএন, রেডিট, অ্যামাজনের মতো অসংখ্য ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপরে ১৭ই জুন প্রায় একই রকমের ঘটনা ঘটে, ফাস্টলি এর মতো আরেকটি প্রতিষ্ঠান আকামাই টেকনোলজি এর কারিগরি ত্রুটির ফলে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স, হংকং স্টক এক্সচেঞ্জ এবং কমনওয়েলথ ব্যাংক অফ অস্ট্রেলিয়া এর মতো অসংখ্য ওয়েবসাইট অচল হয়ে পড়ে।

এ ছাড়াও অ্যামাজনের মত ক্লাউড কম্পিউটিং সেবা তিনবার অচল হয়ে পড়েছিল। যদিও উভয় প্রতিষ্ঠাম্লন সংযোগ বিভ্রাটের সমাধান করতে কয়েক ঘন্টার বেশি সময় নেয়নি। তবে সংযোগ জটিলতার দ্রুত সমাধান হলেও একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিকেন্দ্রিক জীবনে সাধারণ মানুষ ইন্টারনেটের উপর যে কতোটা নির্ভরশীল সেই শিক্ষা উভয় ঘটনা থেকেই পাওয়া যায়।

পরিশেষ

বর্তমানের এই ডিজিটাল বিশ্বে প্রযুক্তি ছাড়া চলা এখন অনেকটাই অসম্ভব। প্রযুক্তি পণ্য এবং সেবা ব্যবহার করে মানুষ ঘরে বসেই অর্থ অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে মানুষ তাদের গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল কাজ সম্পন্ন করছে এবং অনেকখানি সময় সাশ্রয় করছে। সব জিনিসের যেমন ভালর সাথে খারাপ দিক রয়েছে, তেমনি প্রযুক্তির ভাল দিকের পাশাপাশি খারাপ দিক ও রয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে উপকারের চিন্তার পাশাপাশি অপকারের বিষয়টিও ব্যবহারকারীদের চিন্তা করা উচিত। এতে করে নিজেদের বড় রকমের ঝুঁকি থেকে নিজেকে বাচাঁনো সম্ভব।

 

 

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.