Reading Time: 4 minutes

২০২২ সালে সৃজনশীল ছবি, লেখা, অডিও ও ভিডিও নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করে একই সঙ্গে আলোচনা ও সমালোচনা উভয়ই জন্ম দিয়েছে এআই প্রযুক্তি। গবেষকদের টানা কয়েক দশকের গবেষণার অগ্রগতিগুলো কেবল জনসমক্ষে আসেনি, বাণিজ্যিক খাতেও এর সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে ব্যবহারকারীদের মধ্যে। ২০২২ এর বছরে একাধিকবার সংবাদের শিরোনামে এসেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই প্রযুক্তি। যতবারই এআই প্রযুক্তি একটি স্থিতিশীল অবস্থানে পৌঁছানোর আভাস মিলেছে, ততবারই গবেষকরা নতুন এমন কিছু নিয়ে হাজির হয়েছেন যে ঘুরে গেছে স্পটলাইট, পাল্টে গেছে আলোচনার বিষয়।

আজকের আর্টিকেলটিতে এআই এর দেয়া বেশ কয়েকটি আলোচিত এবং সমালোচিত কিছু চমক তুলে ধরা যাক।

গুগলের লামডা এআই

জুলাই মাসে গুগল প্রকৌশলী ব্লেক লেমোইনকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল মার্কিন দৈনিক দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট। ততদিনে লেমোইনকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে গুগল। গুগলের ‘রেসপন্সিবল এআই’ সংস্থায় কাজ করার সময় লামডার সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেন লেমোইন। এক পর্যায়ে এআইয়ের সঙ্গে লেমোইনের আলাপচারিতা গিয়ে পৌঁছায় ধর্মবিশ্বাস আর দর্শনের মত জটিল বিষয়গুলোতে। লামডার কথায় জৈবিক বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার দাবি করেন লেমোইন। 

অর্থাৎ, লেমোইনের বাধতামূলক ছুটি আর পোস্টের বিশেষ প্রতিবেদনের মূল কারণ, গুগলের ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ফর ডায়লগ অ্যাপ্লিকেশন বা লামডা এআই আত্মসচেতন বলে দাবি করেছিলেন উক্ত প্রকৌশলী। তবে গুগলের দাবি ছিল, লেমোইন আসলে যা শুনতে চেয়েছেন লামডা তাকে তাই বলেছে এবং এআইটি মোটেই আত্মসচেতন নয়। চ্যাটজিপিটির জিপিটি-৩ টেক্সট জেনারেটিং টুলের মত লামডাকেও কয়েক কোটি বই আর ওয়েবসাইট পড়িয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে গুগল।

লেমোইনের নির্দেশনার ভিত্তিতে সম্ভাব্যতার বিচারে সবচেয়ে কাছের শব্দগুলো পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সাজিয়ে উত্তর দিয়েছে লামডা, বিষয়বস্তু বুঝে নয়। এআইয়ের আত্মসচেতনতা নিয়ে হইচই করে মাঝখানে গুগলের গোপনীয়তা নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগে বিপাকে পড়েন লেমোইন। জুলাই মাসে ডেটা নিরাপত্তা নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে ছাঁটাই করে গুগল। সে পরিস্থিতি নিয়ে লেমোইন ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান তিনি বুঝতে পারেন তিনি কখন একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন।

তাদের রক্ত-মাংসের মস্তিষ্ক আছে না কি কয়েকশ কোটি লাইনের কোড আছে তাতে কিছুই যায় আসে না। ওদের সঙ্গে তার কথা বলার কারন ওদের কী বলার আছে তা তিনি শুনতে চান এবং তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে যার সাথে তিনি কথা বলছেম সে মানুষ নাকি না।

ডিজিটাল আর্ট বা ম্যানিপুলেটেড ফটোগ্রাফি

এআই-এর সহযোগিতা নিয়ে তৈরি শিল্পকর্মের প্রতিযোগিতা জেতার খবর যতই প্রচার হতে পেতে থাকে, ততই খেপেছেন ডিজিটাল আর্ট শিল্পীরা। বহুল আলোচিত ও সমালোচিত এআইভিত্তিক কার্যক্রমের মধ্যে ডিজিটালি ম্যানিপুলেটেড ফটোগ্রাফি ছিল অন্যতম। বলতে গেলে ২০২২ সালের পুরোটা জুড়েই এআই এর সহযোগিতা নিয়ে তৈরি শিল্পকর্ম নিয়ে কঠোর বিতর্ক চলেছে সৃজনশীল খাতগুলোতে। এআইগুলো নির্মাণে যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হয়েছে তা ইতিবাচক অনেকের কাছে মনে হলেও একে নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন দিনের পর দিন কঠোর শ্রম দিয়ে শিল্প-কৌশল আয়ত্বে আনা শিল্পীরা।

অগাস্ট মাসে এক স্থানীয় আর্ট কম্পিটিশনে এআই এর মাধ্যমে বানানো তিনটি ছবি জমা দিয়েছিলেন কলোরাডোরে বসবাসরত জেসন অ্যালেন। প্রতিযোগিতায় ডিজিটাল আর্ট/ডিজিটালি ম্যানিপুলেটেড ফটোগ্রাফি ক্যাটেগরিতে সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নেয় তার ‘স্পেস অপেরা’ শীর্ষক ছবিটি। স্পেস অপেরা বানাতে মিডজার্নি এআই ব্যবহার করেছিলেন জেসন অ্যালেন যেটি মানুষের তৈরি শিল্পকর্মকে টপকে এআইয়ের জয় শিল্প এবং শৈল্পিক সত্ত্বার সংজ্ঞাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

চ্যাটজিপিটি

এআইটি উন্মুক্ত করার পাঁচদিনের মাথায় ওপেনএআই প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান টুইট করেন, চ্যাটজিপিটির ব্যবহারকারী সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং, রান্নার রেসিপি, কবিতা লেখাসহ নানা কাজে এআইটি ব্যবহার করা শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। ব্যবহারকারীর জটিল প্রশ্ন বোঝার সক্ষমতা আছে চ্যাটজিপিটির। কিন্তু উত্তর যে সবসময় সঠিক, তেমন নয়। এক্ষেত্রে এআইটি আরও উন্নত করার সুযোগ আছে বলে স্বীকার করে নিয়েছেন নির্মাতা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী।

২০২২ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিন চ্যাটজিপিটির ঘোষণা দিয়েছে ওপেনএআই। নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এআইটি বিনা খরচে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে এআই নির্মাতা কোম্পানিটি। ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে এআইটিতে খুঁটিনাটি পরির্বতন আনছে ওপেনএআই। চ্যাটজিপিটি এআইয়ের মূলে রয়েছে জিপিটি-৩ লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। এআইটি বিনাখরচে জনসাধারণের ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ায় প্রথমবারের মত ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলটির সক্ষমতা পরখ করে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন তারা।

দাল-ই টু

ওপেনএআই দাল-ই টু উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরপরই টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে নভোচারীদের ঘোড়ায় চড়ে মহাকাশভ্রমণ বা খেলনা টেডি বেয়ারের প্রাচীণ মিশরের পিরামিড দর্শনের ছবিগুলো। গত বছরের এপ্রিলের দিকে ডিপ-লার্নিং ইমেজ-সিনথেসিস মডেল “দাল-ই” এর দ্বিতীয় সংস্করণের ঘোষণা দিয়েছিল ওপেনএআই। দৃশ্যপটে হাজির হয়েই সবাইকে চমকে দিতে থাকে লিখে দেওয়া নির্দেশনার ভিত্তিতে ছবি নির্মাণে সক্ষম দাল-ই টু।

এআইটির নির্মাতারা একে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত কয়েক কোটি ছবি থেকে। এআইটি সম্ভাব্য অপব্যবহারের শঙ্কায় প্রথম পর্যায়ে দুইশ বেটা টেস্টারের জন্য দাল-ই টু উন্মুক্ত করেছিল নির্মাতা ওপেনএআই। অগাস্ট পর্যন্ত এআইটির সক্ষমতা যাচাই করেছেন ১০ লাখ ব্যবহারকারী। সেপ্টেম্বর মাসে জনসাধারণের জন্য এআইটি উন্মুক্ত করে দিয়েছে কোম্পানিটি। ফলাফল, একই ছবিতে সাংঘর্ষিক বা বিপরীতমুখী মনে হয় এমন ভাবনার সৃজনশীল সংমিশ্রণ।

লো-রেজুলেশনের ছবি রেন্ডার করতেই বিপাকে পড়তো উক্ত এআই এর প্রথম সংস্করণ। কিন্তু এপ্রিল মাসে এসে ১০২৪ বাই ১০২৪ পিক্সেলের ছবিতে মানুষের সবচেয়ে অদ্ভুত ভাবনাগুলোর দৃশ্যায়ন করে চমকে দিতে থাকে দাল-ই টু।

ডিপমাইন্ডের আলফাফোল্ড

২০২২ এর মাঝামাঝি সময়ের দিকে এআই নির্মাতা ডিপমাইন্ড ঘোষণা করে বসে, বিশ্বের প্রায় সকল জীবের প্রোটিন কাঠামো তুলে ধরেছে তাদের আলফাফোল্ড এআই। জনসাধারণরে জন্য উন্মুক্ত একটি ডেটাবেইজে প্রোটিন কাঠামোগুলোর তথ্য-উপাত্ত তুলে দিয়েছে ডিপমাইন্ড। এর ফলে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে গবেষকরা ডেটাবেইজটি ব্যবহার করতে পারছেন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান খাতে নিজস্ব গবেষণায় ডেটাবেইজটি ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন তারা।

সহজ ভাষায় বললে জৈব জীবন গঠনের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয় প্রোটিনকে। ফলে, এর কাঠামো জানা থাকলে ওই কাঠামো নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তনের সুযোগ পান গবেষকরা। বিশেষ করে নতুন নতুন ওষুধ উদ্ভাবনে কাজে আসে এই জ্ঞান। এআইটির প্রথম ঘোষণা এসেছিল ২০২১ সালে। মানবদেহের প্রোটিন কাঠামো বলে দিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল আলফাফোল্ড। এক বছরের ব্যবধানে এআইটির প্রোটিন ডেটাবেইজের যোগ হয়েছে ২০ কোটির বেশি নতুন প্রোটিন কাঠামো।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.