অ্যাপলের দাবী এটি চাইল্ড পর্নোগ্রাফী নিয়ন্ত্রনে ব্যবহার করা হবে কিন্তু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছে এটির উদ্দেশ্য ভিন্ন হতে পারে। ম্যাথিউ গ্রীন, একজন ক্রিপ্টোগ্রাফী বিশেষজ্ঞ টুইটারে জানান যে অনেক স্বাধীন উৎস এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে যে, অ্যাপল তাদের মোবাইল ডিভাইসে ক্লায়েন্ট সাইড সিএসএএম স্ক্যানার বসাবে। যা ব্যবহারকারীর ফোনে থাকা সকল ছবির স্ক্যানকৃত হ্যাশ এঅ্যাপলের সার্ভারে পাঠাবে। ইতিপূর্বে, আইক্লাউডে থাকা ছবিগুলি স্ক্যান করতো অ্যাপল, কিন্তু এবার প্রতিটি আইফোন নিজ থেকে তথ্য পাঠাবে অ্যাপলকে।
যদিও অ্যাপল তাদের বিগত ক্যাম্পেইনগুলিতে প্রাইভেসি নিয়ে তাদের উত্তম কর্মকান্ড বেশভাবে প্রচার করেছে। কিন্তু বারবার অ্যাপল তাদের নিজস্ব গোপনীয়তা ভঙ্গকারী কর্মকান্ড আধারে রাখার চেষ্টা করেছে। অ্যাপল থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশনগুলির প্রাইভেসি প্র্যাক্টিস নিয়ে ব্যবহারকারীদের জানান দেয় এবং চায় ব্যবহারকারীরা সেসব অ্যাপ্লিকেশনগুলি গোপনীয়তা এবং তথ্য নিরাপত্তার ব্যাপারগুলি জানতে পারে। কিন্তু অ্যাপল কখনোই একই জিনিস তাদের নিজস্ব সার্ভিসগুলি এবং অ্যাপগুলি নিয়ে করে না।
যদিও অ্যাপলের বেশিরভাগ সার্ভিস গোপনীয়তা ভঙ্গ করে না কারন অ্যাপল সরাসরি অর্থের বিনিময়ে সার্ভিস বিক্রয় করে থাকে যেখানে ফেসবুক বা গুগল অ্যাড টার্গেটিং এর উপর ভিত্তি করে ব্যবসা করে। কিন্তু আইক্লাউড, আই-ম্যাসেজ এবং আরো কিছু একেবারে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা অ্যাপ্লিকেশনগুলি হতে বিনা অনুমতিতে তথ্য সংগ্রহ করে। অ্যাপলের সার্ভিসগুলিতে ব্যবহৃত এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন ব্যবহার করা হলেও সেই এনক্রিপশনের চাবি অ্যাপলের কাছে থেকে যায়। আইনি সংস্থা কিংবা সরকারী নির্দেশে যেকোন সময়ে অ্যাপল সেই এনক্রিপশন চাবি ব্যবহার করে তথ্য হস্তান্তর করতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে অ্যাপল আইনের পাশে দাঁড়াতে এগুলি করছে কিন্তু বর্তমান বিশ্বে আইনের চেয়ে বেশি রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন গোপনীয়তা ভঙ্গকারী কর্মকান্ড চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। অ্যাপলের এই নতুন হালনাগাদের কারনে অনেকেই অজান্তে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মুখে পড়তে পারেন। কারন, কোন দেশের সরকার চাইলেই অ্যাপলের এই এল্গরিদম ব্যবহার করে রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিক, বিরোধী ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারবে।
উদাহরন হিসেবে আমরা চীনকে দেখতে পারি। দীর্ঘ সময় ধরে চলা চায়না – হংকং সমস্যায় বহু আন্দোলনকারি, সংবাদকর্মী, হংকং স্বাধীনতা সমর্থক নির্যাতিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। চীন কঠোরভাবে দেশী এবং বিদেশীদের মনিটরিং করে এবং বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে চীন সার্ভেলেন্সের মাধ্যমে বিরোধীদের শনাক্ত করেছে। বর্তমানে চীনের সার্ভেলেন্স প্রোগ্রাম দিনে দিনে কঠোর এবং বিস্তর হয়ে চলেছে। অ্যাপলের এই পদক্ষেপ হতে পারে গোপনীয়তা ভঙ্গের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?
যদিও সিএসএএম আপাতপক্ষে ব্যবহারকারীদের জন্যে ক্ষতিকর হবার কথা নয়। অ্যাপল যদি তাদের দাবী বজায় রাখে তবে এটি অপরাধী শনাক্তে সাহায্য করবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ইমেজ হ্যাশ নকল করা মোটেও কঠিন কোন কাজ না। দুটি একেবারেই বিনা সম্পর্কযুক্ত ছবিও একই হ্যাশ বহন করতে পারে। একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি চাইলেই অ্যাপলকে ধোকা দিতে পারে। তাই অপরাধী চক্র এর সমাধান দ্রুত বের করে ফেলতে পারবে। অপরাধীরা চাইলে ঠিক উল্টোটিও করতে পারে, অর্থাৎ কোন নিষ্পাপ ছবিকে অপরাধ ডেটাবেজে থাকা ছবির হ্যাশ দিয়ে কাউকেই ফাঁসিয়ে দিতে পারবে।
অর্থাৎ এতে সহজেই অপরাধীরা পাড় পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই প্রযুক্তি বিপদে ফেলতে পারে সার্ভেলেন্সের আওতায় থাকা নিরপরাধ সাংবাদিক, বিনষ্ট হতে পারে সাধারন ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা। বিশেজ্ঞরা বলেন এটি ঠেকানোর জন্যে অ্যাপলের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু অ্যাপল কি আদৌ তা করবে? উদাহরন স্বরুপ ধরা যায় চীনে অ্যাপলের উপস্থিতি। চীনের বাজারে অ্যাপলের বিশাল বানিজ্য রয়েছে। এবং সেই বানিজ্য বজায় রাখতে চীনের সকল শর্ত মেনে নিয়েছে অ্যাপল, যার মধ্যে রয়েছে চীনের কাছে তথ্য হস্তান্তর, চাইনিজ আইনের সাথে মিল রেখে সফটওয়্যার রোল-আউট ইত্যাদি।
অ্যাপল ব্যবসার জন্যে যে কোন দুষ্কর্ম ঘটাতে রাজি আছে, এবং তা এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। যদিও অনেকে তর্ক করেন যে এটি অপরাধ নিয়ন্ত্রনে কাজ করবে, কিন্তু কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না যে এই প্রযুক্তি অন্য কাজে অ্যাপল লাগাবে না। ব্যাপারটা এমন যেন কোন এত বিশাল কোম্পানী হতে আপনি একটি বাড়ি কিনলেন, কিন্তু সেটার কোনায় কোনায় এমনকি বেডরুমে সিসিটিভি লাগানো। কোম্পানী দাবি করছে এই ক্যামেরা শুধু অপরাধ কমাতে সাহায্য করবে অথচ সেটা নিশ্চিত করার ক্ষমতা আপনাকে দেয়া হয়নি। ব্যাপারটি যেমন ভয়ানক, তেমনই আশঙ্কাজনক।
অন্যান্য কোম্পানীরাও একই কাজ করছে, তবে…
ফটো স্ক্যানিং এবং হ্যাশ ম্যাচিং পূরাতন কিছু নয়। মাইক্রোসফট, গুগল এবং ফেসবুক অনেক আগে থেকেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ডাটা কালেক্ট করে আসছে। গুগলে এবং মাইক্রোসফট ড্রাইভ আগে থেকেই ফটো স্ক্যান করে আসছিলো। এমনকি আইক্লাউডে আপলোড করা ছবিও অনেক আগে থেকেই স্ক্যান করা হতো। কিন্তু, এবার অ্যাপল সেই পদ্ধতির ব্যপ্তি বাড়াচ্ছে। এখন আর শুধু আউক্লাউড নয়, বরং আইফোন, আইপ্যাড এবং ম্যাকে থাকা ফটো এবং অ্যাপল আই-ম্যাসেজে পাঠানো ফটোগুলিও স্থানীয়ভাবে স্ক্যান করা হবে নতুন টুলের মাধ্যমে। অনেকেই বলেছেন যে “অ্যাপল এই কাজে নতুন নয়, এবার শুধুমাত্র তারা এই কাজ আরো ভয়ানকভাবে করছে”।
অ্যাপল এখনো এই ব্যাপারে বিশেষ কোন মতামত প্রদান করেনি, কিন্তু অ্যাপলের আইওএস ১৫ আপডেটে কিছু নতুন প্যারেন্টাল ফিচার বের হয়েছে, অ্যাপল সেই ব্যাপারে মত প্রদান করেছে। সেখানেও একই টুল ব্যবহার করে অপ্রীতিকর ছবি দেখার আগেই ব্লক করার সুবিধা নিয়ে অ্যাপল প্রেজেন্টেশনে বক্তব্য দিয়েছে। এটি নি:স্বন্দেহে এই প্রযুক্তির ভালো ব্যবহার। তাছাড়া ফটো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাছাই, মুখ এবং প্রানী ভিত্তিতে ছবি আলাদা করার ফিচার অনেক আগে থেকেই আইফোনে ছিলো। কিন্তু সেই ডাটা অ্যাপলের কাছে হস্তান্তর করা হতো না, শুধু আইক্লাউডে আপলোড করা ফটোগুলিই পাঠানো হত।
পরিশেষ
অ্যাপল যদিও তাদের প্রাইভেসি নিয়ে ফলাওভাবে প্রচার করে, তবুও অনেক বিশেষজ্ঞ এই কোম্পানীকে “ভন্ডের” খাতায় ফেলেছেন। ২০২০ সালে পরিবেশ রক্ষায় অ্যাপলের পদক্ষেপ প্রচারে মিথ্যাচার এবং অর্থের বিনিময়ে “গ্রীন সার্টিফিকেশন” কেনাসহ বিভীন্ন মিথ্যাচার নিয়ে ইতিমধ্যে লেখালেখি হয়েছে। এরপর রয়েছে প্রাইভেসি নিয়ে ফলাও প্রচার। ফেসবুকের সাথে বিশাল দ্বন্দে জরিয়ে পরেছে অ্যাপল এবং সেই জন্যে অ্যাপল অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু অনেকেই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছেন যে অ্যাপলের এই দ্বন্দ লাইসেন্সিং এবং প্রতিযোগীতা নিয়ে, প্রাইভেসি বিষয়টিকে শুধুমাত্র ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে অ্যাপল। চীনে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চীনকে সকল ডাটা হস্তান্তরে রাজি হয়েছে অ্যাপল। অর্থাৎ, ইউএস এর বাইরে আরেকটি দেশের সার্ভেলেন্স প্রোগ্রামে ইতিমধ্যে যোগ দিয়েছে অ্যাপল।
অ্যাপলের দাবি এই সকলকিছুই ব্যবহারকারীদের জন্যে, এবং ব্যবহারকারীরাও বিশ্বাস করেন। কেননা বড় বড় এইসব টেক জায়ান্টরা আধো-সত্য বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের ট্রিলিয়ন ডলার এর রাজত্ব গড়ে তুলেছেন। কিন্তু সাধারন ব্যবহারকারীরা পেছনের তথ্য ঘাটতে চায় না। এই জন্যে অনেকের দাবি অ্যাপলের কিছু বিষয়ে আরো স্পষ্ট হওয়া জরুরী। বিগত সময়ে পেগাসাস এটাকে অ্যাপলের ত্রুটিও রয়েছে সেটি কোনভাবেই অ্যাপল স্বীকার করেনি বা করবেও না। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন সেই ঘটনাটির পিছনে অ্যাপলের এনএসআই সার্ভেলেন্সের ব্যাকডোর দায়ি।
বর্তমানে অ্যাপল আরো একটি কান্ড করতে যাচ্ছে (লেখার সময়ে ইতিমধ্যে কার্যকর), এবং এবার অনেকখানিই ভয়ানক এলাকায় পা রেখে ফেলেছে তারা। সিএসএএম এর মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে, অর্থাৎ ফোন এবং অন্যান্য অ্যাপল ডিভাইসে রাখা ফটো স্ক্যান করে তার হ্যাশ ডাটা পাঠাবে অ্যাপলের সার্ভারে। এতে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ভঙ্গ হবে এবং বিপদে পরতে পারে বিনা অপরাধকারী ব্যক্তিরা। সাংবাদিক, এক্টিভিস্ট এবং আন্দোলনকারীরা সহজেই এর টার্গেট হতে পারে। বিভীন্ন রাজনৈতিকভাবে অস্থীতিশীল রাষ্ট্রগুলি, যেমন ইন্ডিয়া, চীন, রাশিয়া এই প্রযুক্তি অপব্যবহার করতে পারে।
চীনের কোন সাংবাদিক আন্দোলনের ছবি তোলার জন্যে আটক হতে পারেন। কেউ মজা করে উইনি দা পু এর ছবি ভাগ করার ফলে তার হতে পারে কারাবাস। আন্দোলনকারীরা তাদের তোলা অনিয়মের ছবি ভাগ করার আগেই কারাগারে পা রাখতে পারেন। এমন কতকিছুই না হতে পারে, আর এই রাষ্ট্রগুলি যে এমনটা করবে না, এবং অ্যাপলও তাদের সাহায্য করবে না এমন প্রমান কারো কাছে নেই। আমরা পেগাসাস কান্ড সম্পর্কে জানি। এবং এটিং প্রমান করে প্রাইভেসির মৃত্যু হচ্ছে দিনদিন। আর সেই মৃত্যুর জন্যে দায়ি সেইসব কোম্পানী, যাদের আমরা বিশ্বাস করি প্রাইভেসির রক্ষাকর্তা হিসেবে।