চাঁদ নিয়ে আমরা ছোট বেলায় নানা গল্প শুনেছি। আমাদের রূপকথার গল্পে চাঁদে চরকা কাটা বুড়ির কথাও শুনেছি। এছাড়া চাঁদ নিয়ে কত কবিতাও তৈরি হয়েছে, কবি লেখকগণ চাঁদকে কত রূপেই বর্ণনা করেছেন। আবার কিছু গল্পে চাঁদকে জন্ম-মৃত্যুর কারণ হিসেবে মেনে নেওয়া হতো। এছাড়া পূর্ণিমা বা অমাবস্যার চাঁদকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা ভূতুরে সব কাহিনী। যা সবই ছিল রূপকথার অন্তর্ভূক্ত। চাঁদ পৃথিবী থেকে লক্ষ মাইল দূরে অবস্থিত। কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক লেখক জুলভার্ন “ফ্রম দ্যা আর্থ টু দ্যা মুন” নামক একটি বইয়ে পৃথিবী থেকে চাঁদের কক্ষপথে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমের কথা তুলে ধরেছেন এবং তারই ১০৪ বছর পর মানুষের চাঁদে যাওয়ার অভিযান সফল হয়। কল্পনার জগত পেরিয়ে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করার সাহসিকতা লাভ করেন।
কিছু কারণে আবার চাঁদে অভিযান হঠাৎ থেমে গিয়েছিল। তবে এখানেই সব বন্ধ হয়ে যায়নি। চাঁদ মানুষের বসবাসের উপযুক্ত কিনা সে বিষয়ে এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা। যদিও চাঁদে কোনো আলো, পানি, বাতাস কিছুই নেই। সুতরাং চাঁদ মানুষের বসবাসের উপযোগী বলে চিন্তা করার সম্ভাবনা খুবই কম। বিজ্ঞানের এই যুগে এখন মানুষ চাঁদকে নিয়ে লেখা কবিতা, গল্পের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে বিভিন্ন রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাঁদ নিয়ে আরো গবেষনা চালাচ্ছে বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি চাঁদে জমি কেনার প্রসঙ্গ নিয়ে চারদিকে সাড়া পড়ে গেছে। রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র এই দুই দেশের মাধ্যমে মহাকাশ জয়ের শুরু। সেসময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে এক প্রকার স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। তখন মহাকাশ দখলদারির আশঙ্কা জাগে। এটি ভেবেও তাদের ভয় হচ্ছিল যে পৃথিবীর এরকম সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণের প্রতিক্রিয়া মহাকাশের উপরেও পড়বে কিনা।
“আউটার স্পেস চুক্তি” এর মাধ্যমে মূলত এমন আশঙ্কার সূচনা ঘটে। এতে বলা হয়েছিল যে কোনো রাষ্ট্রই মহাকাশের কোনো বস্তু, গ্রহ বা চাঁদকে নিজের বলে দাবি করতে পারবে না। তবে, চাঁদ বা গ্রহ আবিষ্কার এবং মহাকাশের রহস্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে কারো উপর কোন রকম বাধাবাধ্যকতা নেই। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১১টি দেশ এ চুক্তিতে সই করেছে। বহুকাল আগে থেকেই মানুষ চাঁদের জন্য মালিকানা দাবি করে আসছে। কিন্তু ১৯৮০ সালে ডেনিস হোপ নামের এক মার্কিন নাগরিক চাঁদের মালিকানা দাবি করার সাথে চাঁদের জমি বেচাকেনার জন্য কোম্পানিও গঠন করে করে ফেলেছেন। তার মতে, কোনো ব্যক্তি চাঁদের মালিকানা দাবি করতে পারবে না এমনটা আউটার স্পেস চুক্তির কোথাও লেখা নেই। এরকম নিজস্ব মতামত দিয়েই চাঁদের জমি বিক্রির প্রচারও তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন।
ডেনিস হোপ এখন পর্যন্ত এ খাত থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন! ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি কেবল এই উৎস থেকেই আয় করে যাচ্ছেন। তবে, ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কার মহাকাশ আইন বিষয়ক অধ্যাপক ফ্রান্স ভন ডার ডাঙ্ক বলেন যে হোপের এ দাবি ভুয়া এবং এক ধরনের জালিয়াতি। যে জিনিসের মালিকানারই ঠিক নেই তার বেচাকেনারও কোন ভিত্তি নেই। নিজেদের ইচ্ছেমত কিছু কাগজপত্র তৈরি করে এবং সফটওয়্যারে তৈরি কোনো ফাইলের মাধ্যমে কোনো গ্রহ কিংবা উপগ্রহের জমির মালিকানা দাবি করা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাকাশ ও চাঁদ বিষয়ক চুক্তিগুলো এখন নতুন করে হালনাগাদ করা প্রয়োজন। কারন এগুলো এখন অচল হয়ে গিয়েছে। ১৯৬৭ সালের প্রেক্ষাপটে চুক্তির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশে সামরিক শক্তি এবং নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার না করা।
তবে বর্তমানে বহু দেশ, এমনকি কিছু কোম্পানিও চাঁদে অভিযানের পরিকল্পনা করছে। তাই চাঁদের সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে নানানভাবে প্রশ্ন উঠছে। একটা সময় ছিল যখন চাঁদে জমি কেনা আলাদা অথবা অন্যতম এক উপহার হিসেবে নেওয়া হতো। হোপ এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন যে সাধারানত মানুষ অভিনবত্বের কারনেই মানুষ এর পিছনে অর্থ ব্যয় করে। কিছু মনোঃ বিশেষজ্ঞরা চাঁদে জমি কেনার ব্যাপারকে এক ধরনের আশাবাদ হিসেবে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তবে এটিও বলেছেন যে এর সাথে আশাবাদী মানসিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। চাঁদে জমি কেনা অযথা অর্থ ব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মহাকাশ নিয়ে সাধারন মানুষের আগ্রহ অতীত থেকে বর্তমান অব্দি চলছে এবং ভবিষ্যতেও এটি চলবে। তবে মহাকশের গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথের সাথে মানুষের জন্ম-মৃত্যু কিংবা জীবন ভবিষ্যতের কোন সম্পর্ক নেই।
তবুও মানুষ চাঁদকে তাদের জন্ম মৃত্যুর কারন ভেবে এখনো জ্যোতিষীর কাছে যায়। ঠিক একই ভাবে মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের জমি কেনার ব্যাপারটিকেও এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যায়। চাঁদে জমি কেনার বিষয়টি ভিত্তিহীন জেনেও এখনো বিক্রি করার ইচ্ছা চালিয়ে যাচ্ছে, এর সাথে মানুষ আগ্রহ নিয়েও কিনছে। বিক্রেতাগণ ক্রেতাদের মাঝে চাঁদে জমি কেনার বিষয়ে এমন ধারণা তৈরি করেছেন যে অবাস্তব হওয়া সত্ত্বেও ক্রেতাগণ জমি ক্রয়ের দিকে এখন ঝুকছে। যার ফলে সাধারন মানুষের অর্থ ব্যয় তো হচ্ছেই সাথে এই বিষয়টি এক প্রকার জালিয়াতি হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে।