Reading Time: 4 minutes

বিটকয়েন ক্রিপ্টো মুদ্রা তার খনি ব্যবসায় বা কয়েন মাইনিং-এ মধ্য এশিয়ার এই দেশটি এখন দ্বিতীয় স্থানে প্রথম যে দেশ সেটি হচ্ছে আমেরিকা। এক সময় চীনেও বিটকয়েনের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন হতো, কিন্তু হঠাৎ করেই গত বছর চীন ক্রিপ্টোকারেন্সির খনিগুলো নিষিদ্ধ করে দেয়, তখন থেকেই প্রতিবেশি কাজাখস্তানে এই ব্যবসা দ্রুত প্রসার লাভ করতে শুরু করে। কাজখস্তান বর্তমানে বিটকয়েন লেনদেনের দ্বিতীয় তালিকায়। মলডির শুবাইয়েভা নামের এই প্রথম একজন নারী নতুন ব্যবসায়ে যোগ দিয়েছেন। তার জমির উপর তার প্রকৌশলী ও নির্মান শ্রমিকেরা নতুন বিটকয়েন খনি গড়ে তুলছেন।

কাজাখস্তানে ক্রিপ্টোকারেন্সির যে নতুন ব্যবসা দ্রুত জমে উঠেছে, তাতে নেমে পড়া নতুন ব্যবসায়ীদের মধ্যে মলডির শুবাইয়েভা একজন। আলমাটি শহরে তার নতুন খনি তৈরির যাবতীয় বিষয়গুলো তিনি দেখাশোনা করছেন। মলডির বলছেন যে কাজাখস্তানে এই বিটকয়েনের ব্যবসা এবং একই সাথে তার নিজের ব্যবসাও ভালোই উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে গত বছরে ব্যবসার ঊর্ধ্বগতিতে কোন সময়ই সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। বিটকয়েনের দাম অবিরতভাবে এবং আকস্মিকভাবে ওঠানামা করে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে একটি বিটকয়েন মুদ্রার মূল্য ছিল প্রায় পাঁচ হাজার ডলার।

আর মাত্র এক বছরের মধ্যে একটা কয়েনের দাম মুহূর্তেই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ডলারে। তবে এরপর হুট করেই বিটকয়েনের দাম ব্যাপক হারে কমতে থাকে। কিছুদিন আগেই বিটকয়েনের সর্বশেষ মূল্য কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৫ হাজার ডলারে। কিন্তু এরপরেও কাজাখস্তানে মলডির এবং তার মত অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি খনি মালিকরা এই ব্যবসা থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ অর্জন করেছেন। বিটকয়েন, লাইটকয়েন, এথেরিয়াম এসব নামধারী যেসব ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার তৈরি হয়েছে, সেগুলো ক্রিপ্টো-মাইনিং বা ক্রিপ্টোমুদ্রার খনন এর মাধ্যমেই হোক হয়েছে।

ডিজিটাল মুদ্রা কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে না। কারণ ভার্চুয়াল জগতে এই মুদ্রার লেনদন হয়। যদিও এই মূদ্রার হিসাব রাখা অনেকটাই কঠিন তাই এই ধরনের হিসাব নিকাশের জন্য কম্পিউটারের দরকার হয়। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক জটিল হিসাবনিকাশ করে একেকটি ডিজিটাল মুদ্রা সংগ্রহ করে। নিজস্ব উদ্যোগে ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচালিত বিশাল একটি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রতিটি পেমেন্ট এবং মুদ্রার লেনদেন তত্ত্বাবধান করে এবং সেগুলোর উপর নজর রাখে। মলডিরের মত উদ্যমী বিটকয়েন ব্যবসায়ীদের উৎসাহের ফলে কাজাখস্তান এখন বিটকয়েন মাইনিং-এ আমেরিকার পরই নিজের স্থান করে নিয়েছে।

কাজাখস্তানে ২০১৯ সাল থেকেই এই ক্রিপ্টোকারেন্সি শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে। প্রতিবেশি চীন সেসময় দেশটিতে সবধরনের ক্রিপ্টোমুদ্রার খনিগুলো আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। এই সুযোগে কাজাখস্তান ক্রিপ্টো ব্যবসায়ে উন্নতি আনা শুরু করে। যার ফলে সেখানে অসংখ্য কম্পিউটার যোগ করা হয়। বিটকয়েন মুদ্রা ব্যবস্থাকে সচল রাখতে বিশ্বব্যাপী যে বিটকয়েন তৈরি হচ্ছে, সেই মুদ্রা ভাণ্ডারের প্রায় ১৮% শক্তির উৎস এখন কাজাখস্তান। বিটকয়েন মুদ্রা তৈরির বা খননের জন্য কিছু কোম্পানি কাজাখস্তানে আগে থেকেই গড়ে উঠেছিল।

এই খনিতে প্রায় দেড়শ কর্মী কাজ করেন এবং ২৪ ঘণ্টা এই যন্ত্রগুলোকে সচল ও কর্মক্ষম রাখেন। এখানকার এই অতি শক্তিশালী কম্পিউটারগুলোর পরিচালনার মাধ্যমেই ডিজিটাল মূদ্রা তৈরি হচ্ছে। কয়েক ডজন প্রকৌশলী কাজাখস্তানের এই মরু অঞ্চলে থাকেন এবং এই খনিতে একটানা ১৫ দিনের শিফটে কাজ করেন। এর মধ্যকার আলমায নামক একজন কর্মী কাজ করছেন। কারখানা ঘরগুলো সম্পূর্ণ ধুলাবালিমুক্ত রাখা, কারন ধুলাবালি কম্পিউটারের কার্যক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এছাড়াও কম্পিউটারের যাবতীয় সমস্যা দেখা দিলে আলমায সেটা ঠিক করার দায়িত্বে আছেন।

এক কথায়, কারখানার কম্পিউটারগুলো সচল রাখার গুরু দায়িত্ব তারই উপরে। তিনি ১২ ঘন্টার শিফটে কাজ করছেন। আলমায বলেন যে শুরুতে তার কারখানার কোন যন্ত্রপাতি সম্পর্কে ধারণাই ছিল না। এমনকি বিটকয়েন সম্পর্কেও তিনি কিছু জানতেন না। বিটকয়েন কি বা এর কাজ কি সে সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। ইয়েরবোলসেন আলমায ও তার সহকর্মীদের কাজের ওপর নজর রাখেন। ইয়েরবোলসেন বলেন যে কাজাখস্তান এখন বিশ্বের ক্রিপ্টোকারেন্সি দুনিয়ায় যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এটা তাদের কাছে জন্য খুবই গর্বের। তারা এই উন্নতি আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

বিশেষজ্ঞদের মতে ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং যেভাবে বেড়েছে তাতে জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে এমন উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। দেশটিতে ক্রিপ্টোমুদ্রা খননের কাজে যে পরিমাণ বিদ্যুত ব্যবহার হচ্ছে তা কাজাখস্তানের একটি বড় শহরের আলোর চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সমান। সরকার বলছে এক বছরে যে পরিমাণ মুদ্রা মাইনিং হয়েছে, তাতে দেশ জুড়ে এক বছরে জ্বালানির চাহিদা ৭-৮% বেড়েছে। যেসব এলাকায় পর্যাপ্ত বিদ্যুত সরবরাহ নেই, সেসব এলাকায় বিটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার খনি বসানোর ওপর বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে।

গত নভেম্বর মাসে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতে রাশিয়া থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আমদানি করতে হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে কিছু মাইনারকে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বা ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়েছে। ওই দেশের সরকার জানুয়ারি ২০২২ থেকে এই খনি শিল্পের ওপর বিদ্যুত ব্যবহারের জন্য বাড়তি কর ধার্য করেছে। তাদের আশা এই বাড়তি রাজস্ব ব্যবহার করে তারা দূষণমুক্ত জ্বালানির ব্যবহার গড়ে তুলতে পারবেন। দেশটির ডিজিটাল উন্নয়ন বিষয়ক উপ-মন্ত্রী আসখাত ওরাযবেক বিবিসিকে বলেছেন যে কাজাখস্তানে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসার এই হঠাৎ বৃদ্ধি অতি দ্রুত ঘটেছে, যেটি নিয়ন্ত্রিতভাবে ঘটা উচিত ছিল।

তিনি আরো বলছেন যে কাজাখস্তানের বিটকয়েন মাইনিং শিল্প যে জ্বালানি ব্যবহার করছে তা দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি করছে এবং ক্রিপ্টোমাইনিং ব্যবসার জন্য তারা নির্দিষ্ট কোটা চালু করতে যাচ্ছেন। তার মতে এটি একধরনের প্রযুক্তি বিপ্লব। এই মুহূর্তটা এটা তারা হারাতে চান না। তারা বিশ্বে ক্রিপ্টোকারেন্সি জগতে যে বিপ্লব ঘটছে তার সাথে একতাবদ্ধ হতে চান। জ্বালানির আকস্মিক মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে এ মাসের প্রথম দিকে কাজাখস্তানে ব্যাপক মাত্রায় সহিংস প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। ক্রিপ্টোমুদ্রার মাইনিং-এর সাথে ওই বিক্ষোভের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকলেও, ওই প্রতিবাদ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট হয়েছে।

এক হল, জ্বালানি সরবরাহ হুমকির মুখে পড়লে কী ঘটতে পারে। আর দ্বিতীয়ত বিটকয়েনের মত ক্রিপ্টোমুদ্রার মাইনিং জগতে কাজাখস্তান এখন কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশটি এখনও এই বিক্ষোভের ঢেউ সামলে উঠছে। কাজাখস্তান সরকার বিক্ষোভের সময় যখন পাঁচদিনের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন বিশ্বব্যাপী বিটকয়েন নেটওয়ার্কে তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছিল। যার ফলে বিশ্বে বিটকয়েনের বড়ধরনের দরপতন হয়েছিল। কাজেই নতুন ও দ্রুত বেড়ে ওঠা এই শিল্প জগত কাজাখস্তান সরকার কীভাবে সামাল দেবে তা দেশটির সরকারের জন্য ভবিষ্যতে বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ভিক্ষোভের ফলে এই ডিজিটাল মূদ্রার বাজার ধীর গতি হয়ে পড়েছিল। কাজাখস্তানের এই সাম্প্রতিক সাফল্যে সবাই গর্বিত নয়। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিটকয়েনে বিদ্যুত ব্যবহারের সূচক বলছে ইউক্রেন বা নরওয়ের মত দেশে সারা দেশের জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তার থেকেও বেশি বিটকয়েন মাইনিং করতে বিদ্যুতের দরকার হয়। পরিবেশবাদীরা প্রায়ই সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে উঠছেন। কারন এই মুদ্রার মাইনিং-এর জন্য বিশাল পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডানা ইয়েমলিওনক বলছেন যে কাজাখস্তানে ব্যবহৃত জ্বালানির মাত্র ২% নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসে।

ডানার মতে ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং থেকে দেশটি যে সম্পদ আয় করছে তার থেকে দেশটিকে পরিবেশের জন্য অনেক বড় মাশুল দিতে হচ্ছে। যেহেতু বিটকয়েন একটি বিকেন্দ্রীক ডিজিটাল মূদ্রা সেহেতু মূদ্রার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ ব্যবহারকারীদের হাতে। আমেরিকা, কাজাখস্তান ছাড়াও এল সালভাদর, ইরান, কানাডা, রাশিয়া বিটকয়েন মাইনিং এর ক্ষেত্রে এগিয়ে। যদিও বেশকিছু কোম্পানি এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বিটকয়েন মাইনিং প্রমোট করে যাচ্ছে তবুও বিজ্ঞানীরা মনে করেন বিটকয়েন মাইনিং পরিবেশের উপর বাজে প্রভাব ফেলে।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.