Reading Time: 4 minutes

নাসার পুরনো প্রথা অনুযায়ী বুধবার, বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৪৭ মিনিটের সফল উৎক্ষেপণ মিশনের লঞ্চ ডিরেক্টর চার্লি-ব্ল্যাকওয়েল থম্পসন নিজের টাই কেটে উদযাপন করেছেন। কোনো মানব নভোচারী নেই এ মিশনে, এমনকি চাঁদেও নামবে না কোনো মহাকাশযান। ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটকে প্রথমে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে ছুড়ে দিয়েছে সর্বাধুনিক স্পেস লঞ্চ সিস্টেম বা এসএলএস রকেট। আর চাঁদকে ঘিরে চক্কর দিয়ে পৃথিবীতে ফিরবে ওরিয়ন।

তবে এ মিশনের আসল গুরুত্ব ভিন্ন জায়গায়। মহাকাশ যাত্রার ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আর্টেমিস ওয়ান। কারিগরি জটিলতা আর বৈরি আবহাওয়ার কারণে পরপর তিনবার বাতিল হওয়ার পর অবশেষে চাঁদের পথে যাত্রা শুরু করেছে নাসার আর্টেমিস ওয়ান। নাসার আর দশটি মিশনের সঙ্গে আর্টেমিস ওয়ানের মূল পার্থক্য শেষবারের মত কোনো মানব নভোচারীর পদচিহ্ন পড়ার পাঁচ দশক পর নিল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন আর মাইকেল কলিনসের উত্তরসূরীদের চাঁদে ফেরাতে নাসার প্রথম পদক্ষেপ এটি।

প্রথম দুবার কারিগরি জটিলতার কারণে শেষ মুহূর্তে উৎক্ষেপণ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল নাসা। আর তৃতীয়বার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল আবহাওয়া। হিসেবে ১৬ নভেম্বরের উৎক্ষেপণ ছিল নাসার চতুর্থ চেষ্টা। সব জটিলতার সমাধান করে দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ উৎক্ষেপণের সবুজ সংকেত আসে নাসার কন্ট্রোল রুম থেকে। ৪০ মিনিট বিলম্বে ১২টা ৪৭ মিনিটে গর্জে ওঠে এসএলএসের রকেট ইঞ্জিন। উৎক্ষেপণের দুই ঘণ্টার মাথায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার মাইলের বেশি উচ্চতায় চাঁদের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল আর্টেমিস ওয়ান মিশনের মূল স্পেসক্র্যাফট ওরিয়ন।

গতি ছিল ঘণ্টায় ২ হাজার মাইলের বেশি। বুধবারে বিপত্তি ঘটেছিল এসএলএস রকেটের কোর স্টেজে তরল হাইড্রোজেন সরবরাহের লাইনে। তরল জ্বালানী সরবরাহের লাইনে লিক সারাতে লঞ্চপ্যাডে সশরীরে হাজির হয়েছিলেন নাসার রেড ক্রু দলের প্রকৌশলীরা। নাট-বল্টু টাইট দিয়ে লিক বন্ধ করে লাইভ প্রচারে ‘থাম্বস আপ’ ইঙ্গিত দিয়ে দেন। সাথে তারা জটিলতার সমাধান করে ফেলেছেন। ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটকে কার্যত মহাকাশে ছুড়ে দেওয়ার কাজটি করবে নাসার এসএলএস রকেট।

মহাকাশ সংস্থাটি বলছে, এখন পর্যন্ত তাদের নির্মিত সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস রকেট এটি। এসএলএস পুরোটাই কেবল একটি রকেট এমন নয়। রকেটের ২১২ ফুট উচ্চতার কোর স্টেজ বা মূল অংশের চারটি আরএস-২৫ ইঞ্জিন মাত্র আট মিনিটে ৭ লাখ ৩৩ হাজার গ্যালন প্রোপেল্যান্ট পুড়িয়ে ঘণ্টায় ১৭ হাজার মাইল গতি অর্জন করতে পারে বলে জানিয়েছে নাসা। সেই সাথে এসএলএসের কোর স্টেজ একা নয়। দু’পাশে আছে দুটি সলিড রকেট বুস্টার।

উৎক্ষেপণের প্রথম দুই মিনিটে পুরো মহাকাশযানকে ওপরের দিক ঠেলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির ৭৫ শতাংশ আসবে দুই বুস্টার রকেট থেকে। নাসা দাবি করছে, ৫৯ হাজার ৫২৫ পাউন্ডের বেশি ওজনের কার্গো দূর মহাকাশে পাঠানোর লক্ষ্য মাথায় রেখে নকশা করা হয়েছে এসএলএস রকেটের। আর রকেট থেকে আলাদা হওয়ার পর ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটকে চাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাবে ইন্টেরিম ক্র্যায়োজেনিক প্রোপালশন স্টেজ বা আইসিপিএস এর আলএল১০ ইঞ্জিন।

এরপর চাঁদের দিকে একাই এগিয়ে যেতে থাকবে ওরিয়ন। এবারের মিশনে নভোচারী না থাকলেও, নাসা স্পেস ক্যাপসুলটির নকশা করেছে পরবর্তী মিশনে নভোচারীদের বহনের জন্যই। এবার কেবল ওরিয়নের কার্যক্ষমতা আর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করবে নাসা। মানব নভোচারী না থাকলেও শূন্য ককপিট নিয়ে মহাকাশে যাচ্ছে না ওরিয়ন। একাধিক ছোট ছোট স্যাটেলাইট বা কিউবস্যাট বহন করবে মহাকাশযানটি। আর্টেমিস ওয়ান মিশনের জন্য ছোট ছোট স্যাটেলাইটগুলো সরবরাহ করেছে ইতালিয়ান স্পেস এজেন্সি বা এএসআই।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

সাথে আছে জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাক্সা, লকহিড মার্টিন, ইউনিভার্সিটি অফ টোকিওসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষণা সংস্থা। আর এই কিউবস্যাটগুলোর প্রত্যেকটিরই রয়েছে আলাদা আলাদা বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে চন্দ্রপৃষ্ঠের ইনফ্রারেড ছবি তোলার মতো নানা কাজ করবে স্যাটেলাইটগুলো। ভবিষ্যৎ নভোচারীদের ওপর মহাকাশযাত্রা ও মহাজাগতিক তেজস্ক্রিয়তার সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে মহাকাশযানটির তিন যাত্রীর আসনে থাকবে তিনটি ম্যানিকিন বা মানবাকৃতির পুতুল।

পুতুলগুলোর সঙ্গে দুটি সেন্সর জুড়ে দিয়ে রেখেছে নাসা। পুতুলগুলোর একটির নামকরণের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল নাসা। সেই প্রতিযোগিতা থেকে একটির নামকরণ করা হয়েছে কমান্ডার মুনিকিন ক্যামপোস। কমান্ডার ক্যামপোস ছাড়াও গুরুত্ব পাচ্ছে ওরিয়নের যাত্রী কিউবস্যাটগুলো। ওরিয়ন সব মিলিয়ে ১০টি কিউবস্যাট বহন করছে বলে জানিয়েছে নাসা। তবে, এর কোনোটি নাসার তৈরি নয়। সময়ের সে দাবি মেটানো আর মঙ্গলযাত্রার দুয়ার খোলার চাবিকাঠি হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে নাসার আর্টেমিস প্রকল্প।

প্রকল্পের প্রথম মিশনে নতুন রকেট, মহাকাশযান ও অন্যান্য প্রযুক্তির কার্যক্ষমতা যাচাই করবে নাসা। নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হলে পরবর্তী মিশনগুলোতে অংশ নেবেন নভোচারীরা। তারপর ক্রমান্বয়ে চাঁদের বুকে আর্টেমিস বেজ ক্যাম্প বানাবে নাসা। যেন চাঁদেই দীর্ঘ সময় থাকতে পারেন মানব নভোচারীরা। উপগ্রহটি থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ ও ভবিষ্যৎ গবেষণার কাজগুলো পরিচালিত হবে ওই বেজ ক্যাম্প থেকে। তারপর চাঁদের কক্ষপথে নতুন স্পেস স্টেশন গেইটওয়ে নির্মাণ করতে চায় নাসা।

মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি ছাড়াও এটি ব্যবহার করতে পারবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। মঙ্গলসহ দূর মহাকাশে মানব নভোচারীদের যাত্রায় গেইটওয়ে আর আর্টেমিস বেজ ক্যাম্প মাঝপথের স্টেশনের মতো কাজ করবে বলে আশা বিজ্ঞানীদের। কিন্তু এ সবই দূরের পরিকল্পনা। আর এ সব পরিকল্পনা সত্যি হওয়ার প্রথম শর্ত, সফল হতে হবে আর্টেমিস ওয়ান মিশন। দূর ভবিষ্যতে রেড প্ল্যানেট খ্যাত মঙ্গলে মানব বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছেন নাসাসহ অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা।

আলোচিত বিতর্কিত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কও আছেন সে দলে। নিজের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের মাধ্যমে একই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছেন তিনি। অন্যদিকে, বয়স ফুরিয়ে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আইএসএস এর। স্পেস স্টেশনের মূল অংশীদারদের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কও ভালো যাচ্ছে না অন্যদের। সর্বশেষ, ২০৩০ সাল পর্যন্ত আইএসএসের খরচ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন। সব মিলিয়ে, মহাকাশে মানব নভোচারীদের জন্য নতুন একটি নির্ভরযোগ্য স্পেস স্টেশন এখন সময়ের দাবি।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.