সম্প্রতি ইনস্টাগ্রাম রিলস নির্মাতাদের পাওনার অর্থ কমিয়ে দিয়েছে এবং কনটেন্ট প্রচার থেকে আয়ের জন্য প্রচারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সীমাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইনস্টাগ্রাম ২০ রিলস প্লে বোনাস প্রোগ্রাম চালু করেছিল ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে। সে সময় ফেসবুক রিলস নির্মাতাদের জন্য আর্থিক তহবিল তৈরির কথা বলেছিল। ফাইন্যানশিয়াল টাইমস জানিয়েছে যে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রিলসের প্রতি ভিউ থেকে নির্মাতাদের পাওনা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কয়েক কোটিতে আয়ের জন্য ভিউয়ের লক্ষ্যমাত্রা গিয়ে ঠেকেছে।
মেটা নির্মাতাদের টিকটক থেকে ইনস্টাগ্রামের দিকে টানতেই প্রথম অবস্থায় রিলস বোনাস প্রোগ্রাম এর ঘোষণা দিয়েছিল। প্রযুক্তিভিত্তিক সাইট ভার্জ বলে যে সেই প্রকল্পের পাওনার আকার কমিয়ে দিলে নির্মাতারা ইনস্টাগ্রামের পেছনে সময় দিতে আগ্রহ হারানোর আশঙ্কা থাকতে পরে। পুরোনো সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিকটকের অপ্রত্যাশিত সাফল্যে টনক নড়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো পুরনো ব্যবহারকারীদের ধরে রাখতে এবং নতুনদের আকৃষ্ট করতে পরোক্ষভাবে টিকটকের দেখানো পথেই হাঁটছে।
রিলস নির্মাতাদের বরাত দিয়ে ফাইন্যানশিয়াল টাইমস জানিয়েছে যে পাওনার হিসাব করার প্রক্রিয়ায় আকস্মিক পরিবর্তন আনলেও মেটা সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। রিলস তৈরির উদ্যোগটি সে সময় টিকটকের ছোট ছোট ভিডিও নকল করতেই চালু হয়েছে এমন ব্যাখ্যা ভালোভাবেই সাড়া জাগায়। রিলস এর জন্য কন্টেন্ট নির্মাতাদের জন্য ছোট ভিডিও বানিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভিউয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলেই ছয়শ ডলার থেকে ৩৫ হাজার ডলার পর্যন্ত আয়ের সুযোগ ছিল। তবে শুরু থেকেই নির্মাতাদের মধ্যে প্রতি রিলসের জন্য আর্থিক বরাদ্দের হার এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল।
রিলস বোনাস একযোগে ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে বলে নির্মাতাদের পাওনা নির্ধারণ প্রক্রিয়া পরিমার্জনের ফলে পাওনার আকার ওঠানামা করতে পারে বলে ফাইন্যানশিয়াল টাইমসকে মেটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। বাণিজ্য প্রকাশনাটিকে এক কনটেন্ট নির্মাতা জানিয়েছেন, প্রথমে ৩৫ হাজার ডলার কামাইয়ের জন্য তার রিলস ভিউয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ কোটি ৮০ লাখ ডলার থাকলেও সেটি এখন বেড়ে ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ভিউ হয়েছে। একই বিষয়ে ভার্জ মেটার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও প্রতিষ্ঠানটি তাৎক্ষণিক কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
অন্যদিকে মেটা ২০২২ সাল জুড়ে কনটেন্ট নির্মাতাদের পেছনে একশ কোটি ডলার খরচের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ইনস্টাগ্রামের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান টিকটক ও স্ন্যাপচ্যাট কনটেন্ট নির্মাতাদের নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে রাখতে একই ধরনের তহবিল গঠন করেছে বাজারে। তবে নির্মাতাদের অনেকে এমন তহবিলগুলোর সমালোচনাও করেছেন। বিজ্ঞাপনী আয়ের তুলনায় এই প্রকল্পগুলো থেকে সম্ভাব্য আয়ের আকার কম ও অনিশ্চিত বলে তাদের অভিযোগ। প্রতিদ্বন্দী বাজারে ফেসবুক তাল মেলাতে না পারার কারনে তাদের ব্যবসা আগের মত চাঙা করতে আবার প্রতিযোগিতা শুরু করে।
সামাজিক যোগাযোগের যতোগুলো প্ল্যাটফর্ম আছে তার মধ্যে টিকটক অল্প সময়ে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগে বাজারশীর্ষ মাধ্যমটি টিকটকের জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে এবার পরিকল্পিতভাবে প্রচারণার তহবিল জোগান দিয়েছে। চীনের প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্ম এতো দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো পুরনো প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রতিষ্ঠানটি বড় এক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ আগেই ফেসবুক ১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিয়মিত ব্যবহারকারী সংখ্যা কমার খবর জানিয়েছিল।
এক প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে যে এমন পরিস্থিতিতে বাজারের উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বীর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করতে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘টার্গেটেড ভিকটোরি’কে ফেসবুক অর্থ সাহায্য দিচ্ছিল। আর প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুকের অর্থ সাহায্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে টিকটক বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে যে টার্গেটেড ভিক্টোরি স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সংবাদপত্রে মতামত নিবন্ধ এবং সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। প্রযুক্তিভিত্তিক সাইট ভার্জের মাধ্যেম জানা যায় যে টার্গেটেড ভিকটোরি বিভিন্ন সংবাদপত্রে যে মন্তব্য নিবন্ধগুলো প্রকাশ করিয়েছে সেগুলোতে টিকটক নিয়ে নেতিবাচক সংবাদের লিংক থাকতো।
নিবন্ধগুলোর লেখকদের মধ্যে ডেমোক্রেট দলের সদস্যরাও আছেন। তবে কোনো নিবন্ধেই অর্থ সাহায্য পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফেসবুকের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ ছিল না। ফেসবুকের সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন বলছে যে প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের শেষ নাগাদ প্রায় পাঁচ লাখ ব্যবহারকারী হারিয়েছে। এমন বাস্তবতায় ওয়াশিংটন পোস্ট প্রতিদ্বন্দ্বীর সুনাম নষ্ট করতে ফেসবুকের পরিকল্পিত প্রচারণার খবর জানায়। ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে আসা একটি ইমেল এ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন অধীনস্তদের বলেন যে তার প্রতিষ্ঠানকে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে হবে যে মেটা এখনকার পাঞ্চিং ব্যাগ হলেও টিকটক ও হচ্ছে আসল শত্রু।
বিশেষ করে অ্যাপটির মালিকানা যখন বিদেশী প্রতিষ্ঠানের এবং তরুণ ব্যবহারকারীরা যে ডেটা শেয়ার করছেন সেই হিসেবে এক নম্বর। টানা কয়েক বছর ধরেই ফেসবুক যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের চাপের মুখে আছে। সামাজিক মাধ্যম খাতে প্রতিষ্ঠানটি বেআইনিভাবে একাধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে, এমন অভিযোগ বর্তমানে অহরহই শোনা যাচ্ছে। ভার্জ জানায় যে টিকটকের সবচেয়ে কঠোর সমালোচকদের মধ্যে রিপাবলিকান পার্টির সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সিনেটর মার্কো রুবিও সেন্সরশিপের অভিযোগে অ্যাপটি তদন্তের দাবি তুলেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প অ্যাপটি সরাসরি নিষিদ্ধ করেছিলেন।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালে এসে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেন। ২০২০ সালের এক কংগ্রেস শুনানিতে ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ নথির বরাত দিয়ে আইনজীবিরা বলেছিলেন যে ইনস্টাগ্রাম ফেসবুকের কাছে মালিকানা বিক্রি করতে রাজি না হলে সে সময়ের উদীয়মান ফটো শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে জাকারবার্গ বিধ্বংসী মূর্তি ধারণ করতেন। সে সময় ডেমোক্রেটিক পার্টির জনপ্রতিনিথি প্রমিলা জয়পাল বলেছিলেন যে যখন একটি আধিপত্যকারী প্ল্যাটফর্ম সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের হুমকি দেয়, সেটা কখনোই স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কৌশল হতে পারে না।
অন্যদিকে, রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে প্রচারণা চালানো সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর টার্গেটেড ভিকটোরি একটি। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল ২৩ কোটি ডলারের বেশি এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর সেবাগ্রাহকদের তালিকায় আছে। বর্তমানে বহুল আলোচিত-সমালোচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক নিয়ে নতুন নতুন অনেক গুঞ্জন অনবরত চলছেই।