রাইড-হেইলিং প্ল্যাটফর্ম উবার শাস্তি এড়াতে ২০১৬ সালের সার্ভার ব্রিচের ঘটনা চেপে যাওয়ার অভিযোগ আদালতে স্বীকার করেছে। কোম্পানির নেতৃত্ব প্রদানে বড় পরিবর্তন এলে ব্যবসায়ের নৈতিক সততা এবং আইনের প্রতি অনুবর্তিতা নিয়ে নতুন নেতৃত্ব কঠোর হওয়ার পরই সার্ভার ব্রিচের ঘটনা সম্পর্কে এফটিসিকে উবার জানিয়েছিল। রয়টার্স জানিয়েছে, তথ্য গোপনের অভিযোগে অপরাধী হিসেবে বিচার এবং সম্ভাব্য শাস্তির ঝুঁকি এড়াতেই মার্কিন আইনজীবীদের সঙ্গে উবার সমঝোতায় পৌঁছেছে।
ওই ঘটনায় পাঁচ কোটি ৭০ লাখ চালক ও আরোহীর স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁস হয়েছিল। সমঝোতার অংশ হিসেবে কোম্পানিটি সরকারপক্ষের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, ২০১৬ সালের সার্ভার ব্রিচের ঘটনা স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফটিসি (ফেডারেল ট্রেড কমিশন) কে জানাতে ব্যর্থ হয়েছিল উবার এর কর্মীরা। ওই সময়ে সংস্থাটি কোম্পানির ডেটা নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা তদন্ত করছিল। স্যান ফ্রান্সিসকোর আদালতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারপক্ষের আইনজীবী স্টেফানি হাইন্ডস বলেন, সার্ভার ব্রিচের ঘটনা প্রকাশের আগে উবার এক বছর সময়ক্ষেপণ করেছে।
কোম্পানির নেতৃত্ব বড় পরিবর্তন আসার পর এবং ব্যবসায়ের নৈতিক সততা এবং আইনের প্রতি অনুবর্তিতা নিয়ে নতুন নেতৃত্ব কঠোর হওয়ার পরই উবার সার্ভার ব্রিচের ঘটনা সম্পর্কে এফটিসিকে অবহিত করেছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। তার মতে, অভিযোগপত্রে উবারকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত না করার সিদ্ধান্তে বাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে তদন্তে সহযোগিতা করতে এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কোম্পানির নতুন ব্যবস্থাপনার উদ্যোগের প্রতিফলন রয়েছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, নিজস্ব প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি চিহ্নিত করার বদলে নিরাপত্তা গবেষকদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখলেও ডেটা চুরির ঘটনা চেপে যেতে যাওয়ার বদলে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। সার্ভার ব্রিচের ঘটনা কর্তৃপক্ষকে জানাতে দেরি করার ঘটনায় ওয়াশিংটন ডিসিসহ যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের পক্ষ থেকে তোলা অভিযোগ নিস্পত্তি করতে উবার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার জরিমানা দিয়েছিল।
২০১৮ সালেই এফটিসিকে আগামী ২০ বছরের জন্য একটি সামগ্রিক গোপনীয়তা প্রকল্প চালু রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল উবার। সাবেক নিরাপত্তা প্রধান জোসেফ সালিভানের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনাতেও কোম্পানিটি সহযোগিতা করছে। সার্ভার ব্রিচের ঘটনা চেপে যেতে মূল ভূমিকা রাখার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রয়টার্স এ প্রসঙ্গে উবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর পায়নি। সালিভানের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগ আনা হয়েছে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
বাদীপক্ষের অভিযোগ, হ্যাকারদের এক লাখ ডলার সমমূল্যের বিটকয়েন দিয়েছিলেন সালিভান, উক্ত হ্যাকাররা যেন সার্ভার ব্রিচের বিষয়ে মুখ না খোলে সে জন্য তাদের দিয়ে একটি চুক্তিতেও স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন আগে উবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে সাড়ে পাঁচশ নারীর যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে। উবার চালকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগ তুলে রাইড-হেইলিং প্ল্যাটফর্ম উবারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সাড়ে পাঁচশ জন নারী।
বুধবার উবারের বিরুদ্ধে স্যান ফ্রান্সিসকোর আদালতে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী নারীরা। বিবিসি জানিয়েছে, মামলার নথিতে ‘উবার চালকদের বিরুদ্ধে অপহরণ, যৌন নিপীড়ন, যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ, বেআইনিভাবে বন্দী করা, অনুসরণ, হয়রানি এবং সহিংস হামলার’ অভিযোগ তুলেছেন তারা। অভিযোগে বলা হয়েছে ২০১৪ সালেও উবার জানতো যে কোম্পানিতে নিবন্ধিত চালকরা নারী যাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালাচ্ছে। কিন্তু কোম্পানিটি সে সময় যাত্রীর নিরাপত্তার চেয়ে ব্যবসা প্রসারণেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন।
এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগীদের প্রতিনিধিত্বকারী আইনি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘স্লেটার স্লেটার শুলম্যান’ এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অ্যাডাম স্লেটার মন্তব্য করেছেন, উবারের পুরো ব্যবসায়িক ধারণাই মানুষকে নিরাপদে বাড়ির ফেরার সেবা দেওয়ার ভাবনা কেন্দ্রীক। কিন্তু যাত্রীর নিরাপত্তায় তারা কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। যাত্রীর নিরাপত্তায় আপোস করে ব্যবসা বাড়ানোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের কাছে। মামলা প্রসঙ্গে এক উবার মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, যৌন নিপীড়ন একটি ভয়াবহ অপরাধ এবং আমরা প্রতিটি অভিযোগকে সমান গুরুত্ব দেই।
নিরাপত্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। যার কারণে উবার নতুন নিরাপত্তা ফিচার নির্মাণ করেছে, ভুক্তভোগীদের কথা মাথায় রেখে নীতিমালা বানিয়েছে এবং গুরুতর ঘটনাগুলোর বেলায় আরও স্বচ্ছতা বজায় রেখেছে। যদিও বিচারাধীন মামলা নিয়ে মন্তব্য করতে পারছেন উবার মুখপাত্র, তবে তিনি বলেন নিরাপত্তার বিষয়টিকে তাদের কাজের কেন্দ্রেই রাখবেন। বিবিসি জানিয়েছে, মামলার নথিতে ‘উবার চালকদের বিরুদ্ধে অপহরণ, যৌন নিপীড়ন, যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ, বেআইনিভাবে বন্দী করা, অনুসরণ, হয়রানি এবং সহিংস হামলার’ অভিযোগ তুলেছেন তারা।
বিবিসি আরো জানায় যে মামলার নথিপত্র অনুযায়ী যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের। এমন আরও দেড়শ ঘটনা এখনও তদন্ত করে দেখার কথা জানিয়েছে ভুক্তভোগী নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী আইনি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। জুন মাসে উবার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের দ্বিতীয় নিরাপত্তা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কোম্পানির নিজস্ব প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে, কেবল ২০২০ সালেই যৌন নিপীড়নের ৯৯৮টি ঘটনা ছিল। এর মধ্যে ১৪১টি ছিল ধর্ষণ সম্পর্কিত ঘটনা।
সোমবারেই কোম্পানির সাবেক চিফ অফ পলিসি ম্যার্ক ম্যাকগান ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, উবার সবসময়ই নিজের ব্যবসাকেই অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ম্যাকগানের ফাঁস করা তথ্য উপাত্ত থেকে প্রমাণ মিলেছে, তদন্তকারীরা যেন কোম্পানির কম্পিউটার সিস্টেম প্রবেশাধিকার না পান, সেটি নিশ্চিত করতে বিশেষ ‘কিল সুইচ’ বানিয়ে রেখেছিল উবার। যৌন নিপীড়নের মামলাটিতেও একই ধরনের অভিযোগের কথা বিবিসি জানিয়েছে।
বিবিসি জানায় কোম্পানির চালকরা যে নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করছেন সে বিষয়টি চেপে গিয়েছে উবার। অর্থাৎ, নারী যাত্রীদের জন্য রাইডের ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত থাকলেও বারবার নিজেদের সেবাকে নিরাপদ বলে চালিয়ে দিয়েছে উবার। কোম্পানিটি চালকদের অতীত কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে যাচাই করে দেখেনি– এমন অভিযোগও আনা হয়েছে মামলায়। ২০১৯ – ২০ সালে যৌন হয়রানির সবচেয়ে গুরুতর পাঁচটি শ্রেণিতে তিন হাজার ৮২৪টি অভিযোগ পেয়েছে উবার।
কোম্পানির প্রথম নিরাপত্তা প্রতিবেদনে ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ছিল পাঁচ হাজার ৯৮১টি। বিবিসি বলেছে, সাড়ে পাঁচশ নারী যে অভিযোগগুলো এনেছেন তার বেশিরভাগই গুরুতর অভিযোগ। ভুক্তভোগীর সংখ্যাটিও চমকে যাওয়ার মতোই।ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ নথিপত্র বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুষ আর অপকর্মের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের মতো অনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে আর স্থানীয় ট্যাক্সি বাজার ধসিয়ে কোম্পানিটি শীর্ষে উঠেছে।
তখন তথ্য ফাঁসকারী হিসেবে উবারের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ম্যার্ক ম্যাকগান জনসমক্ষে এসেছেন। সময়টা একেবারেই ভালো যাচ্ছে না রাইড হেইলিং প্ল্যাটফর্মটির। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে কোম্পানির আন্তর্জাতিক ব্যবসায় কৌশল নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান এবং ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজি)’র লেখা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কোম্পানির নানা বেআইনি কর্মকাণ্ড