Reading Time: 4 minutes

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কত মানুষ পাচারের শিকার হন, তার সঠিক কোন তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। তবে ইউরোপীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে প্রবেশ করেছে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ। অভিবাসন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ৫,০০০ মানুষ বাংলাদেশ থেকে এভাবে উন্নত দেশগুলোয় যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ ও অভিবাসন কর্মীরা বলছেন, শিকার ফাঁদে ফেলতে এখন নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম।

পরিচিতদের মাধ্যমে বা সরাসরি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ফুঁসলিয়ে বা লোভ দেখিয়ে একসময় মানব পাচার করা হলেও প্রযুক্তি এখন সেখানে বড় উপাদান হয়ে উঠেছে। মানব পাচারের শিকার ধরতে, তাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে বা পাচারকারীদের নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগে প্রযুক্তি বড় উপকরণ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার ও অপব্যবহার প্রতিপাদ্যে বলা হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে মানব পাচারকারীরা শিকার চিহ্নিত করতে, দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফাঁদে ফেলতে বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

মানব পাচার বিরোধী দিবসে জাতিসংঘের প্রতিপাদ্যে এই বিষয়টি বেরিয়ে আসে।

পাচারের নতুন পথ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে বা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ নজরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান যে প্রযুক্তির নেতিবাচক আর ইতিবাচক দুটো দিকই আছে। এখন সব অপরাধীদের মত মানব পাচারকারীরাও প্রযুক্তির ব্যবহার খুব বেশি করছে। একসময় সরাসরি বা পরিচিতদের মাধ্যমে মানুষদের বিদেশে চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচারের চেষ্টা করা হলেও সামাজিক মাধ্যমগুলো এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে।

অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রন্টিয়ারের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, যত মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে আটক হয়েছে, বাংলাদেশ সেই তালিকায় তৃতীয়। গত বছর ৭,৫৭৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ বেশি হচ্ছে জানিয়ে নজরুল ইসলাম আরো বলেন যে অপরাধী হয়তো দেশের বাইরে আছে। তিনি ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোবাইল বা অন্য কোন মাধ্যমে টাকা নিচ্ছেন। তাকে ভুক্তভোগীর সামনাসামনি একে অপরকে দেখা হচ্ছে না।

ভুক্তভোগী প্রতারিত হলেও মূল আসামীকে দেখছেন না। আবার ভাইবার, ইমো ব্যবহার করে তাকে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে, খুব সহজে টার্গেট করা হচ্ছে। বিবিসির তথ্যমতে জানা যায়, প্রায় তিন বছর আগে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশী এক কর্মী। স্থানীয় একটি কলেজে স্নাতক পড়ার সময় এই ব্যক্তি ফেসবুকে ইতালির একটি গ্রুপের সদস্য হয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। সেখান থেকে তাকে স্থানীয় একজন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এরপর তিনি ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন।

কিন্তু লিবিয়ার ত্রিপলি যাওয়ার পর একটি গ্রুপ তাকে বন্দী করে। পরবর্তীতে পরিবার আরও পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ পাঠিয়ে তাকে দেশে ফেরত নিয়ে আসে।

টিকটক, ইমো, ফেসবুকের মাধ্যমে পাচার

সাম্প্রতিক সময়ে এরকম একটি পাচারের ঘটনা বেশ আলোড়ন তৈরি করে। সেটি, ভারতে পাচার হওয়া একজন নারী তিনমাসের বন্দী দশা থেকে পালিয়ে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করার পর পুলিশ একটি চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। সেই তরুণীকে টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করা হয়েছিল। পরে সেখানে তাকে আটকে রেখে যৌনকর্ম বাধ্য করা এবং নির্যাতন করা হয়। মাসে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে বলে গবেষকরা ধারণা করেন।

শুধুমাত্র ভারতে পাচার হওয়া দুই হাজার নারীকে গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে বিদেশে ভালো চাকরি আর নারী-শিশু কিশোরীদের পাচারের ক্ষেত্রে ভালো চাকরি, নায়িকা বা মডেল বানানোর লোভ দেখানো হয়। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলছেন মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখা গেছে ফেসবুক, টিকটক, ওয়াটসঅ্যাপ, ইমো এই সমস্ত জায়গায় তারা সক্রিয়, তাদেরকে পাচারকারীরা টার্গেট করছে।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

কাউকে কাউকে ভারতে পাচারের জন্য তারা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করছে, প্রলোভন দেখাচ্ছে, কখনো টিকটকের মডেল বানানোর কথা বলছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহায়তা ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এক নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। সেখানে তারা দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে অথবা ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে মানব পাচারের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার বেড়েছে। বিশেষ করে ফেসবুক, টিকটক, ইমোসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে।

শরিফুল ইসলাম বলছেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ায় প্রলুধ করতে অনেক ধরনের ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে কোনো নৌকা ইউরোপে যেতে সফল হলে সেসব ভিডিও বা ছবি এসব পেজে দিয়ে অন্যদের প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। আর টাকার লেনদেনের ক্ষেত্রেও হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমো ব্যবহার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা আমরা যারা কাজ করছি, তাদের চেয়ে তারা অনলাইনে অনেক বেশি সক্রিয়। এর একটি কারণ হতে পারে, তরুণ-তরুণী বা কিশোর-কিশোরীরা অনলাইনে অনেক সক্রিয়।

সেই কারণে তারাও এখানে তৎপরতা বাড়িয়েছে বলে তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান।

অপরাধীদের ধরার চেষ্টা চালানো হচ্ছে

বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ নজরুল ইসলাম বলছেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব পাচার, স্মাগলিং ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে তারা সবসময়েই তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছে। এটা ব্যবহার করে আসামীদের অপরাধ স্থল শনাক্ত করে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা সহজ হচ্ছে। প্রযুক্তি এ ব্যাপারেও বিশাল একটা সুযোগ তৈরি করছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বিশ্বব্যাপী মানব পাচারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন ব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

এই কারণে এই বছর জাতিসংঘ এই বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করছে। তিনি আরো জানান মানব পাচারকারীরা যাতে  ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোর মতো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে না পারে, তাদের যাতে সহজে শনাক্ত করা যায়, সেজন্য তারা এসব প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। একদিকে অপরাধীরা যেমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অপরাধী শনাক্ত করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

পাচারের মত জঘন্য ঘটনা ছাড়াও টিকটক, ফেসবুক কিংবা হোয়্যাটসঅ্যাপের মত প্রযুক্তি মাধ্যমগুলো নিজেরাই একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে। বহুল ব্যবহৃত এই সামাজিক মাধ্যমগুলো শুরু থেকেই নীতিমালা ভঙ্গ করে আসছে। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ফেসবুক কিংবা টিকটক অপ্রীতিকর কনটেন্ট, বিদ্বেষ ছড়ানো বা ব্যবহারকারীদের অনুমতি ছাড়া তথ্য চুরির মত জঘন্য কাজগুলো এখনো করেই যাচ্ছে। ফেসবুক ও টিকটক অ্যালগরিদম নিয়ে ব্যবহারকারীরা এখনো হতাশ।

টিকটক বর্তমানে নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে নারী বিদ্বেষী ভিডিও নিষিদ্ধ করার দাবি করলেও তরুণদের মধ্যে নারী বিদ্বেষী ভিডিওর প্রচারই বেশি করছে।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.