একাধিক নাটকিয়তার পর অবশেষে টুইটারের সিইও পরাগ আগারওয়ালসহ কয়েক শীর্ষ কর্মীকে বরখাস্ত করার মাধ্যমে ইলন মাস্ক প্রবেশ করলেন প্লাটফর্মটিতে। ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে টুইটার কেনার সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে এই সোশাল মিডিয়া কোম্পানির মালিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন টেসলা নির্মাতা ইলন মাস্ক। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী রস গারবারের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইলন মাস্ক ৪৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
সংবাদ মাধ্যম বিবিসির মাধ্যমে মাস্কের টুইটার কেনার কথা জানা যায়। অধিগ্রহণ চুক্তি সারতে আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়ের ৪৮ ঘণ্টা বাকি থাকতেই টুইটার সদর দপ্তরে পা দিয়েছিলেন নতুন টুইটার প্রধান। আর সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি সিঙ্ক! টুইটারের অধিগ্রহণ পর্ব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি দীর্ঘ কাহিনীরও সমাপ্তি ঘটল অবশেষে, যেখানে মাস্কের বার বার মন বদল, টুইটারের বিক্রি হতে না চাওয়া এবং পরে মাস্ককে চুক্তি অনুযায়ী কিনতে বাধ্য করতে আদালতে যাওয়ার মত নাটকীয় উত্থান পতন বিশ্ব দেখেছে।
একটি ভিডিও টুইট করে মাস্ক ক্যাপশনে লিখেছিলেন, এন্টারিং টুইটার এইচকিউ, লেট দ্যাট সিঙ্ক ইন। টুইটারে এখন তিনি নিজের পরিচয় দিচ্ছেন ‘চিফ টুইট’ বলে। টুইটারে মাস্কের বিনিয়োগের বিষয়টি প্রথমে সবার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। জানুয়ারি মাস থেকেই টুইটারের শেয়ার কিনছিলেন টেসলা ও স্পেসএক্স প্রধান ইলন মাস্ক। মার্চ মাসে তার টুইটারে ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে নেয়া কথা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এপ্রিল মাসের মধ্যে কোম্পানির সবচেয়ে বেশি শেয়ারের মালিকে পরিণত হন মাস্ক।
মাস শেষ হওয়ার আগেই ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে কোম্পানি কিনে নেওয়ার সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। সে সময়ে স্প্যাম অ্যাকাউন্ট দূর করে প্ল্যাটফর্মটিকে বাকস্বাধীনতার জন্য নিরাপদ প্লাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন মাস্ক। কিন্তু মে মাসের মাঝামাঝি সুর পাল্টান; প্ল্যাটফর্মে বট ও স্প্যাম অ্যাকাউন্টের সংখ্যা টুইটারের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি বলে অভিযোগ তোলেন। জুলাই মাসে সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে আসার ইচ্ছা জানান মাস্ক।
কিন্তু টুইটারের পক্ষ থেকে পাল্টা অভিযোগ তুলে বলা হয়, সমঝোতা চুক্তির কারণে অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে আইনত বাধ্য ইলন মাস্ক। টুইটার এরপর আদালতেও যায়। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে মামলার বিচার কাজ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে আবার মত পাল্টান মাস্ক। বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করলে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দেন। টুইটার মাস্কের প্রতিশ্রুতিতে রাজি না হলেও, মাস্ককে দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে বিচার কাজ স্থগিত করে ডেলাওয়্যারের আদালত।
সেই সময় শেষ হওয়ার আগেই টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নিলেন উক্ত টেসলা প্রধান। আর অধিগ্রহণ পর্ব সেরে টুইট করে মাস্ক বলেছেন, তার টুইটার কেনার উদ্দেশ্য টাকা বানানো নয়। গত কয়েক মাসে প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরে পতন আর সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টুইটারের নতুন সেবাগ্রাহকদের আকৃষ্ট করার ব্যর্থতার কারণে বাজার বিশ্লেষকদের অনেকেরই মত, বেশি দাম দিয়ে টুইটার কিনেছেন মাস্ক। কিন্তু টেসলার সর্বশেষ প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের সময় মাস্ক দাবি করেছিলেন।
টুইটার এমন একটা সম্ভাবনাময় সম্পদ যা দীর্ঘ দিন ধরে পিছিয়ে পড়ে আছে। তবে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামেই যে টুইটার কিনছেন, তা সরাসরি স্বীকার করে নিয়েছিলেন টেকনোকিং। অধিগ্রহণ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার খবর বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন টুইটারের বিনিয়োগকারী রস গার্বার। রস গার্বার কাওয়াসাকি ইনভেস্টমেন্টের এই প্রধান নির্বাহী বলেন, খুব সম্ভবত আদালত তাকে বাধ্য করেছে টুইটার কিনতে। সত্যি বলতে, শুরু থেকেই এটা খুব গোলমেলে ছিল।
ইলন মাস্কের আক্রমণাত্মক আচরণে টুইটার আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়েছিল বলে মনে করেন তিনি। অন্যদিকে একাধিক মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, কোম্পানি মাস্কের অধীনে যাওয়া মাত্র পরাগ আগারওয়াল ছাড়াও বরখাস্ত হয়েছেন কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা নেড সিগাল, আইন ও নীতিমালাবিষয়ক শীর্ষ নির্বাহী বিজয়া গাড্ডে, প্রধান আইনজীবী শন এজেট এবং প্রধান গ্রাহকসেবা কর্মকর্তা সারাহ পার্সোনেট। শুক্রবার টুইটার শেয়ারের লেনদেন স্থগিত রেখেছে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সেচেঞ্জ।
বিবিসি লিখেছে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিদায় করে দিলেও মাস্ক নিজে হয়ত এখন প্রধান নির্বাহীর পদে বসছেন না। তবে কোম্পানি যে এখন পুরোপুরি ইলন মাস্ক এর নিয়ন্ত্রণে, তা নিশ্চিত। বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভুয়া তথ্য প্রচারের অভিযোগে টুইটারে নিষিদ্ধ হওয়া ব্যক্তিরাও এখন মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্মটিতে ফেরার সুযোগ পেতে পারেন বলে জানিয়েছে বিবিসি। তবে টুইটারে নিষিদ্ধ হওয়া রক্ষণশীলদের তালিকায় ডনাল্ড ট্রাম্প থাকলেও, আর কখনোই টুইটারে ফিরবেন না বলে আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
প্রধান নির্বাহী পরাগ আগারওয়ালের সঙ্গে মাস্কের মতবিরোধের বিষয়টি উঠে এসেছিল আদালতে জমা দেওয়া নথিপত্রে থেকেই। তাই আগারওয়ালের বিদায় সেই অর্থে অপ্রত্যাশিত ছিল না। আর মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্মটির দিক পরিবর্তনেরও স্পষ্ট সঙ্কেত এটি। যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই আগারওয়ালের প্রস্থানকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। আগারওয়াল এবং তার পূর্বসূরী জ্যাক ডরসিকে উদারপন্থী এবং বাকস্বাধীনতার জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করেন রক্ষণশীলদের অনেকে।
এ দুজনের কারণে টুইটার রক্ষণশীল কণ্ঠে সেন্সরশিপ আরোপ করছিল বলেও অভিযোগ তাদের। বরখাস্তের পর ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও পরাগ আগারওয়াল আনুমানিক ৪২ মিলিয়ন ডলার বা ৩৪৫ কোটি রুপি পেতে পারেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে। গতকাল শুক্রবার ঠিক এমনটিই জানিয়েছে ভারতীয় গনমাধ্যম এনডিটিভি। গত বছর নভেম্বরে পরাগ আগারওয়ালকে টুইটারের প্রধান নির্বাহী হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
আইআইটি বোম্বে ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী পরাগ আগরওয়াল প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় আগে টুইটারে যোগ দিয়েছিলেন। তখন এর কর্মী সংখ্যা এক হাজারের কম ছিল। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, সে বছর টুইটার থেকে পরাগ ৩০ মিলিয়নের বেশি আর্থিক সুবিধা পান। এর একটি বড় অংশ এসেছিল টুইটারের শেয়ার হিসেবে। এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টুইটার আগে জানিয়েছিল যে, যদি প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণভার পরিবর্তনের এক বছরের মধ্যে পরাগ আগরওয়ালকে বরখাস্ত করা হয় তাহলে তিনি ক্ষতিপূরণ হিসাবে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ পেতে পারেন।
এই অর্থের মধ্যে থাকবে তার মূল বেতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার হিসাবও।