Reading Time: 5 minutes

তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, গত চার বছরে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে এই আইনের নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ হয়েছে। বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের চার বছর পূর্ণ হয়েছে এবং সাংবাদিক ও অধিকার কর্মীরা বলছেন এ চার বছরে আইনটি দেশে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে।

আর্টিকেল নাইনটিন সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন, সরকার সমালোচনায় ভীত হয়ে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্যই আইনটি করেছিলো এবং দেশে এখন সেই পরিবেশই তৈরি হয়েছে। দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

এরপর আইনটি কার্যকর করার পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর এর অপপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। আইনটি বাতিলের জন্য সম্পাদক, সাংবাদিক, অধিকার কর্মী ও অনেক রাজনৈতিক দল দাবি করলেও সরকার বরাবরই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে বলেছেন, আইনটি বাতিল না করে বরং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে তারা জাতিসংঘের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যা বলা হয়েছে

আইনটি প্রস্তাবের পর থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের কর্মীরা। তাদের আশঙ্কা, আইনটির অনেক ধারায় হয়রানি ও অপব্যবহার হতে পারে। আইনে বলা হয়েছে:

• ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জন শৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তার করতে পারবে।

• আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

• কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে এবং এজন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।

• আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

• ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এরকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

• ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে।

• কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের বিষয়েও বিধান রয়েছে এই আইনে। সেখানে ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম. কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ব্যাহত করে, এমন ডিজিটাল সন্ত্রাসী কাজের জন্য অপরাধী হবেন এবং এজন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা এনধিক এক কোটি অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

• ছবি বিকৃতি বা অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছেকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে কারো ব্যক্তিগত ছবি তোলা, প্রকাশ করা বা বিকৃত করা বা ধারণ করার মতো অপরাধ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ইন্টারনেটে পর্নগ্রাফি ও শিশু পর্নগ্রাফির অপরাধে সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

• কোন ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া অনলাইন লেনদেন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

• বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো বসে বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলেই তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে এর মধ্যে করা সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবস পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে বলেছেন নানা আলোচনার এই আইনে মামলার হার অনেক কমেছে। সরকার আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের সাথে একযোগে কাজ করছে। যেখানে সংশোধনের দরকার সেটি করা হবে, বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

আইনের অপব্যবহারের মুখে পড়া একজন সাংবাদিক

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় এক জেলায় ঠাকুরগাঁওয়ে তানভীর হাসান তনু নামের একজন সাংবাদিকতা করেন। গত বছর ছয়ই জুলাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে গিয়েছিলেন টেস্ট করাতে। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান দুপুরে হাসপাতালের রোগীদের যে মূল্যের খাবার দেয়ার জন্য সরকার টাকা বরাদ্দ দেয় তার চেয়ে অনেক কম মূল্যের খাবার পরিবেশন করা হয়।

তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, তিনি ভেবেছিলেন নিজের যেহেতু করোনা হয়েছে তাই ঘরে বসেই এটি নিয়ে রিপোর্ট করবেন এবং তাই করলেন। ৯ই জুলাই রিপোর্ট প্রকাশিত হলো এবং পরদিনই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হাসপাতালের মান ক্ষুণ্ণের অভিযোগ করে তিনিসহ দুজন সাংবাদিকের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। এরপর তাকে অযথা অ্যারেস্ট করা হয়।

তিনি আরো বলেন যে এই মহূর্তে তিনি জামিনেই আছেন। কিন্তু এর ফলে যা হয়েছে এখন তা ভাবতে কিংবা তা নিয়ে লিখতে গেলেই নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার চিন্তা মাথায় আসে। তাদের এলাকায় সাংবাদিকরা এ আইনে হেনস্থার ভয়ে সত্যিকার অর্থেই ভীত। ফেসবুকে কিছু লেখার আগেই চিন্তা করতে হয় কী থেকে আবার কী হয়। মিস্টার হাসানকে গ্রেফতারের ঘটনায় তখন সারাদেশে সংবাদকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিলো।

ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে একদিন পরেই আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন তিনি। তানভীর হাসানের ঘটনা পরে ওই এলাকার আরও চারজন সাংবাদিকের নামে এই আইনে মামলা করেছেন সরকারি দলের স্থানীয় একজন নেতা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভুল প্রয়োগে লেখকের মৃত্যু

২০২০ সালের মে মাসে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। এর মধ্যে লেখক মুশতাক আহমেদ কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকা অবস্থাতেই মারা যান গত বছর ফেব্রুয়ারিতে। এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ হলে সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগের কথা জানায় যদিও তা ‌এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

তবে চলতি বছর মে মাসে পাবলিক প্রসিকিউটরদের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যদি কোনো মামলা হয়, তাহলে দয়া করে সরকারি কৌঁসুলিরা যেন আগে খুঁজে বের করেন যে ওইটা আদৌ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হওয়ার মতো কি না। না হলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে তিনি তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

ওইদিনই তিনি জানিয়েছিলেন যে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে বলেছেন যে এ আইনে মামলা হলেই যেন সাথে সাথে গ্রেফতার না করা হয়। যদিও এরপরেও এ আইনে মামলার পরপরই গ্রেফতারের নজির আছে।

অধিকাংশ মামলা সরকারের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারীদের

চলতি বছর অগাস্ট পর্যন্ত এই আইনে ৭৯টি মামলা হয়েছে যাতে আসামী ১৭১ জন। এদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ৪৬ জন। এর মধ্যে ৫৩টি মামলাই হয়েছে ফেসবুকে বা অনলাইনে মত প্রকাশের কারণে। এর মধ্যে আটটি মামলা করেছে পুলিশ ও র‍্যাব। আর সরকারি দল সংশ্লিষ্টরা মামলা করেছে ৪৩টি। এর মধ্যে ২৫টিই হয়েছে শুধু প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতাদের নিয়ে মন্তব্যের কারণে।

আর্টিক্যাল নাইনটিন শুধু ২০২১ সালের উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে। সরকারি দলের এসব নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ছাড়ারও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন।

যাদের নিয়ে কটূক্তির অভিযোগেও এ আইনে মামলা হয়েছে। তবে এটি সত্যি যে আইনটি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবাদ ও শোরগোলের প্রেক্ষাপটে চলতি বছর এ আইনে তুলনামূলক কম মামলা হয়েছে। চলতি বছর সতেরটি মামলায় ৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। আর জেলে গেছেন পাঁচ জন। এর আগে ২০১৮ সালে ৩৪টি, ২০১৯ সালে ৬৩টি, ২০২০ সালে ১৯৭টি ও ২০২১ সালে ২৩৮টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।

অর্থাৎ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৬১১ টি মামলা হয়েছে গত চার বছরে এবং বিভিন্ন মামলায় গত তিন বছরেই মোট ৫৩ জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে। আর্টিকেল নাইনটিন এর দক্ষিণ এশীয় পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলছেন, ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্যই আইনটা করা হয়েছিলো গত নির্বাচনের আগে। এ আইনে শাস্তি হয়েছে কম। শুধু হেনস্থার জন্যই আসলে এটি হয়েছে যাতে করে সেলফ সেন্সরশিপ করে সাংবাদিকরা।

আর মানুষ যেন সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা না করে। এখন সেটিই হয়েছে, মানুষ ভয় পাচ্ছে। সে পরিবেশ সরকার তৈরি করেছে।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.