Reading Time: 4 minutes

কম্পিউটার গেম ভালোবাসে না এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। ছোট বড় নির্বিশেষে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কম্পিউটার গেম এখনো তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। এককালে কম্পিউটার গেম নেশার মত কাজ করতো। স্কুল, কলেজ ফাঁকি দিয়ে বাচ্চারা কম্পিউটার গেম খেলতে দোকানে ভীর জমাতো। এখনও অনেক বাচ্চারা গেম খেলতে একবার শুরু করলে আর ছাড়তেই চায় না। যদিও বাচ্চাদের অভিভাবকের ক্ষেত্রে এটি মহা দুশ্চিন্তার বিষয়। কম্পিউটার গেম সম্পর্কে সবারই কমবেশি জানা আছে, কিন্তু এর সূচনাটা এখনো প্রায় অনেকেরই অজানা। এই আর্টিকেলটিতে কম্পিউটার গেম বিপ্লবের সূচনা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

কম্পিউটার গেম বিপ্লবের এর সূচনা

১৯৭২ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের এক বাড়ির গ্যারেজে এমন এক জিনিস উদ্ভাবিত হয়েছিল যা আজ শত শত কোটি ডলারের বিশ্বব্যাপি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বিবিসির লুইস হিদালগো তার সাথে কথা বলেছেন, ১৯৭০ এর দশকে বিপুল জনপ্রিয় হওয়া এবং যার হাত ধরে কম্পিউটার গেম “পং” এর উৎপত্তি। তিনি আর কেউ নন, তিনি পং এর নির্মাতাদের একজন এবং কম্পিউটার গেম কোম্পানি আটারির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নোলান বুশনেল। তিনি বলেন এটি সৃষ্টি হয়েছিল তাদের একজন ইঞ্জিনিয়ারের জন্য একটা প্রশিক্ষণ প্রকল্প হিসেবে।

তারা এটা নিয়ে কাজ করতে করতে কিছু জিনিসকে একটু উন্নত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরকমই একটা পরিবর্তন করার পর দেখা গেল, পুরো জিনিসটা একটা ভীষণ মজার খেলায় পরিণত হয়েছে। তখনই তাদের কাছে মনে হয়েছিল যে তারা একটি মজার এবং আশ্চর্যজনক জিনিস বানিয়ে ফেলেছেন। এ খেলাটি মূলত টেবিল টেনিস খেলার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। আর এর নাম পং দেয়া হয়েছিল। এটিকে কম্পিউটারের পর্দায় টেবিল টেনিস খেলার অন্যতম নতুন ধরন ও বলা যায়। নোল্যান বুশনেল ও তার বন্ধু টেড ড্যাবনি তখন একটি কম্পিউটার গেম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাকে “আটারি” তারা নাম দেন।

বুশনেল আরো বলেন যে তখন ব্যালি ম্যানুফ্যাকচারিং এর সাথে তার একটি চুক্তি ছিল। চুক্তিটি ছিল যে তারা ওদের জন্য একটা গাড়ি চালানোর ভিডিও গেম তৈরি করে দেবেন। কিন্তু এই টেবিল টেনিস গেমটা তৈরির পর তারা চিন্তা করেছিলেন, এটাই হয়তো সবাই পছন্দ করবে এবং সেই সাথে তাদের চুক্তিটাও পুরো হয়ে যাবে। এই গেমটি তাদের টাইম গছিয়ে দেয়ার জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ব্যালি ম্যানুফ্যাকচারিং তাদের বললো যে তাদের ড্রাইভিং গেমই দরকার। এরপর এই গেমটা বুশনেল এর হাতে রয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত ১৩টা গেমিং মেশিন তারা বানাতে সক্ষম হন।

সেই সাথে তারা নগদ টাকায় গেম বিক্রি করা শুরু করেছিলেন। তারপর তারা আরো ৪৫টি গেম বানান এবং পরবর্তীতে যা ঘটলো তা বুশনেল ও তাদের সহকর্মীদের অবাক করে দিয়েছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলে এ্যান্ডি ক্যাপস ট্যাভার্ন নামে একটি বারকে বুশনেল অনুরোধ করেছিলেন যেন তারা এই পং খেলাটিকে একটি আর্কেড ভিডিও গেম হিসেবে স্থাপন করে তখনই তিনি এবং তার সহপ্রতিষ্ঠাতা উপলব্ধি করলেন যে তারা একটা বিরাট সম্ভাবনাময় কিছুর সম্মুখীন হচ্ছেন। গেম সর্বত্র ছড়িয়ে যাবার পর যখন তারা ক্যাশবাক্স খোলেন তখন তারা রীতিমত ভীষণভাবে অবাক হোন।

তারা দেখলেন বাক্সটি কয়েনে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। সেই সময় পং গেম প্রতিদিন ৩৫, ৪০ বা এমনকি ৫০ ডলার পর্যন্ত আয় করছিল। এখান থেকেই তারা গেমটি আবিষ্কারে সফলতা লাভ করেন। আটারি কোম্পানি দুবছর পর এই পং গেমের একটা ঘরোয়া সংস্করণ তৈরি করলো। এটি একটি তার দিয়ে টিভির সাথে সংযুক্ত করা যেতো। আর গেমটিতে দুজন অংশগ্রহন করতে পারতো। প্রথমে টিভি বন্ধ করে তার এরিয়াল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হতো। তারপর গেম সিমুলেটরের কেবলটি টিভির সাথে জুড়ে দিয়ে আবার টিভি অন করতে হতো। দুই খেলোয়াড় দুটি গেম কন্ট্রোলার হাতে নিয়ে টিভির পর্দায় টেনিস খেলা শুরু করতে পারতো।

এখান থেকেই কম্পিউটার বা হোম ভিডিও গেম বিপ্লবের সূচনা ঘটে।

গেম এর হঠাৎ জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়া

পং গেমটির এত অর্ডার আসছিল যে তাদের সরবরাহ করার ক্ষমতার চেয়ে বেশি ছিল। তাদের কোন কারখানা ছিল না, এই ব্যবসা পরিচালনার মত কোন ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া কিছুই ছিল না। তাছাড়া তাদের বয়স ও খুবই কম ছিল, সাথে তারা অনভিজ্ঞ ও ছিল। কাজটি করতে করতেই তারা শিখতে চেষ্টা করছিল। তারা অনেক কাজই সাব-কন্ট্রাক্ট হিসেবে অন্য প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করাতো। গেম মেশিনের ক্যাবিনেট অন্য জায়গা খেকে করিয়ে আনা হচ্ছিল। তারা সাধারণ টেলিভিশন সেট পাইকারি দরে কিনে আনতো এবং তাতে কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে সেটা ক্যাবিনেটে বসানো হতো।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

তারপর তাতে কম্পিউটারটি সংযুক্ত করে তা টেস্ট করা হতো, এবং গ্রাহকের কাছে পাঠানো হতো। পুরো ব্যাপারটা ছিল বেশ ঝামেলার। যে গেম হিসেবে পং যে এত সফল হয়েছে তার বেশকিছু কারণ আছে। পং এর সফলতার পেছনে তিনি তিনটি কারন দেখিয়েছিলেন। প্রথমত তার মতে এটি একটি বিশেষ স্থান কাল পাত্রের মধ্যে একটা মজার ঘটনা ছিল। দ্বিতীয়ত, গেমটি ছিল এমন একটি জিনিস যাতে দেহের ছোট ছোট পেশীগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই এই খেলায় একজন সাধারণ নারী খেলোয়াড় একজন সাধারণ পুরুষ খেলোয়াড়কে হারাতে পারবেন।

১৯৭৫ সাল অব্দি দেখা গেল যে এই পং গেমটি বাচ্চাদের জন্য বড়দিনের বিশেষ উপহার হিসেবে সবচেয়ে কাঙ্খিত জিনিস হয়ে উঠেছে। আর আটলান্টিকের ওপারেও তার আবেদন ছড়িয়ে পড়েছিল। পং গেমের সূচনার সময়টি ছিল উইমেন্স লিব বা নারী স্বাধীনতার উন্মেষের সময়, এবং এই গেমের মধ্যে দিয়ে মেয়েদের একটা দারুণ ক্ষমতায়ন হতো। কারণ সেসময় একটা বারের মধ্যে একজন নারীর পক্ষে পং খেলার জন্য একজন পুরুষকে চ্যালেঞ্জ করাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। তাছাড়া গেমটিতে এমন একটি আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল যে প্রথম লেভেলের গেমটি খেললে কেউ হারুক বা জিতুক আরেকটি লেভেল গেম না খেলে সে থাকতে পারবে না।

তৃতীয় কারণটি হলো, তখনকার লোকেরা এমন কোন খেলা আগে দেখেনি যা এত আধুনিক এবং আনন্দদায়ক। আর গেমটি বোঝা এবং নিয়ন্ত্রণ করাও বেশ সহজ ছিল। পং গেমটি যে পরিমাণ অর্থ আয় করছিল তা ছিল একটি বিরাট বিস্ময়। কিন্তু তারপরে এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বুশনেল জানান গেমটি খ্যাতি লাভ করার পর এর জনপ্রিয়তাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা বের করতে তারা খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

গেমটি শত শত ডলারের ব্যবসায় রূপান্তর

নোলান বুশনেলকে মনে ভিডিও গেম শিল্পের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মনে করা হয়। নিউজউইক তাকে এমন ৫০ জনের তালিকায় ঠাই দিয়েছে যারা আমেরিকাকে বদলে দিয়েছে। ১৯৭০ এর দশকে পং আমেরিকায় এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে এর কারণে সেদেশে ২৫ সেন্টের কয়েনের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল এমনটা মনে করা হয়। আর ভিডিও গেম শিল্প এরপর ক্রমাগত বিকশিতই হতে থেকেছে। বুশনেল বলেন যে তখন তার বয়স ২৮ ছিল। তার কোম্পানির নির্বাহীদের বেশির ভাগেরই বয়স ও ছিল ২৮ এর কাছাকাছি। আর আমাদের কর্মচারীদের বেশির ভাগের বয়স ছিল তার চেয়েও কম, অনেকে তখন মাত্র বিশের কোঠায় পড়েছে।

একদিন তিনি নিজ চোখেই লক্ষ্য করেন যে লোকে তার তৈরি গেম মেশিনে ২৫ সেন্ট ঢুকিয়ে গেম খেলছে এবং তা থেকেই এ অর্থনীতিটা তৈরি হয়েছে। এটা তার কাছে আরো চরম আনন্দের ছিল। তখনকার দিনে এটা খুব সাধারণ ঘটনা ছিল না। তিনি আরো বলেন যখন তিনি এ যাত্রা শুরু করেছিলেন তখন তার মা মনে করেছিলেন, তিনি একটি ভালো চাকরি ছেড়ে একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমেছেন। তবে পরে অবশ্য তার ধারণা হয়েছিল যে বুশনেল যা করছেন তা একটা দারুণ ব্যাপার। তিনি মনে করেন যে স্টিভ জবস, বিল গেটস যারা তার পরে এসেছিলেন তাদের জন্য তিনি একটি পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন।

কারণ তার আগে কোন বড় ইলেকট্রনিক কোম্পানির সিইও না যার বয়স বিশের কোঠায় ছিল। সেটা একটা অন্যরকম সময় ছিল। পং এর মাধ্যমে কম্পিউটার গেমের সূচনা থেকে ধীরে ধীরে আরো নতুন গেমের আবির্ভাব ঘটে। এখনো বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়ষ্ক লোকেরাও কম্পিউটার গেম পছন্দ করছেন। চাকরিজীবীরাও কাজের ফাঁকে কম্পিউটার গেম এ নিজের অবসর সময়ে কাটাচ্ছেন আনন্দে। 

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.