Reading Time: 5 minutes

এক সময় বহুল জনপ্রিয় এবং একমাত্র সেরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ফেসবুক। যেখানে মানুষ নিজের ব্যক্তিগত চিন্তাধারার পাশাপাশি বিভিন্ন ছবি, মুহূর্ত এবং বিভিন্ন রকম তথ্য শেয়ার করতো। এরপর ফেসবুকের সাথে যুক্ত হয় ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, অকুলাস এবং সব মিলিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মেটা। তবে জনপ্রিয়তার আড়ালে যোগাযোগ মাধ্যমটির সাথে যে কতগুলো ভয়ানক তথ্য জড়িয়ে আছে তা অনেকেই জানে আবার অনেকেই জানে না। ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে ব্যবহারকারীর শেয়ার হওয়া বিভিন্ন ছবি ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে আয় করা হতো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।

ব্যবহারকারীর ছবি এবং তথ্যগুলো বিক্রি করা হতো তৃতীয় কোন পক্ষের কাছে। এছাড়াও ভুয়া তথ্য, মিথ্যাচার, বৈষম্য, বিদ্বেষ ইত্যাদি ঘৃণামূলক কর্মকান্ডের উপযুক্ত মাধ্যম এই ফেসবুক। আর এর পেছনে মেটার স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতাই দ্বায়ী সেটিও এখন অজানা নয়।

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা মামলায় অভিযুক্ত জাকারবার্গ

সম্প্রতি মার্ক জাকারবার্গ পুরোনো কেলেঙ্কারির ঘটনায় নতুন মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। আলোচিত কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ঘটনায় মার্ক জাকারবার্গের নাম অভিযুক্তদের তালিকায় এসেছে। জাকারবার্গই ব্যবহারকারীদের অনুমতি ছাড়া ডেটা সংগ্রহের পথ করে দিয়েছিলেন বলে ডিস্ট্রিক্ট অফ কলোম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল কার্ল রাসিন অভিযোগ তুলে নতুন মামলা করেছেন। ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই তাদের ডেটা সংগ্রহ করার পেছনে মূল হোতা যে মার্ক জাকারবার্গই তা প্রমাণিত হয়েছে আগেই। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২০১৮ সালেই মেটার বিরুদ্ধে রাসিন মামলা দায়ের করেছিলেন।

উক্ত মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় জাকারবার্গের নাম যোগ করতে চাইলেও আইনি জটিলতায় তিনি সেটি করতে পারেননি। গত বছরে জাকারবার্গের নাম অভিযুক্তদের তালিকায় যোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও নতুন মামলায় রাসিনের মূল অভিযোগগুলো একই আছে বলে প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট ভার্জ জানিয়েছে। রাসিনের অভিযোগ জাকারবার্গ ভোক্তা অধিকার আইন লঙ্ঘন করেছেন। তিনি নিজ প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকারীদের ডেটার গোপনীয়তা নিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন এবং গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টিও চেপে গেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন জাকারবার্গ কেবল ফেসবুকের নামমাত্র প্রধান নন।

সুতরাং প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তে তিনি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত এবং তার প্রভাবের বিষয়টিও গোপন নয়। তিনি আরো বলেন এমন নজিরবিহীন নিরাপত্তা লঙ্ঘনের কারণে লাখ লাখ মার্কিনির ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে এবং জাকারবার্গের নীতিমালার মাধ্যমেই ফেসবুকের অসাধু কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কয়েক বছর ধরে ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই মামলা কেবল ন্যায্য মামলা নয়, বরং প্রয়োজনীয়ও বটে। এ মামলাটি প্রধান নির্বাহীসহ কর্পোরেট নেতৃত্বকে স্পষ্ট বার্তা দেবে যে কর্মকাণ্ডের দায়ভার তাদেরই বহন করতে হবে। ঘটনার সূত্রপাত ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজের প্রফেসর অ্যালেক্সান্ডার কোগানের মাধ্যমে।

অনুমতি ছাড়াই দুই লাখ ৭০ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহ করে কোগান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মূল প্রতিষ্ঠান ‘এসসিএল গ্রুপ’ কে সরবরাহ করেছিলেন। কেমব্রিজ মামলাটি এখনও চলছে। আর চলমান মামলাটি থেকে উঠে আসা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই জাকারবার্গের বিরুদ্ধে নতুন মামলা করা হচ্ছে বলে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছে। নতুন মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে, দুর্বল গোপনীয়তা নীতিমালা তৈরি করে অনুমতি ছাড়া ব্যবহারকারীর ডেটা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে সরবরাহ করার জন্য জাকারবার্গ সরাসরি দায়ী।

এ ছাড়াও, জাকারবার্গ সময় মতো ব্যবহারকারীদের ওই ঘটনা জানাতে এবং বেহাত হওয়া ডেটা মুছে দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৫ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় কাজ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। ঘটনাটি ২০১৮ সালে জাকারবার্গ ফাঁস হওয়ার পর জনসমক্ষে এর দায়ভার স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

চাপের মুখে পড়ে ভুয়া তথ্য সরিয়েছে ফেসবুক

ইতিমধ্যে মহামারীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস নিয়ে আড়াই কোটির বেশি ভুল তথ্য সরিয়ে ফেলেছে বলে জানিয়েছে। মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মিসইনফরমেশন প্রডাক্ট পলিসি ম্যানেজার অ্যালিস বুডিসাত্রিও এ তথ্য জানান। মেটা কর্মকর্তা অ্যালিস ভুল তথ্য ঠেকানোর জন্য ফ্যাক্ট-চেকার ও বিশেষজ্ঞদের শরনাপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে ফেসবুকের জন্য বিশ্বব্যাপী ৮০টি ফ্যাক্ট-চেকিং সহযোগী প্রতিষ্ঠান ৬০টির বেশি ভাষায় কাজ করে।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

ফ্যাক্ট-চেকে ভুয়া ও ভুল তথ্য হিসাবে উঠে এলে ওই কনটেন্টগুলো নিউজফিডে কম দেখানো হয়, যার ফলে কম মানুষের কাছে পৌঁছায়। নিজেদের মাধ্যমে ভুল তথ্য রুখতে ফেসবুক তিন ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে জানিয়ে অ্যালিস বলেন যেসব কনটেন্ট ও অ্যাকাউন্ট আমাদের কমিউনিটি স্টান্ডার্ডস ও বিভিন্ন নীতিমালা লঙ্ঘন করে সেগুলো তারা সরিয়ে ফেলেন। ফেসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘনের কারণেই ভুল তথ্য অপসারণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন ২০২০ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ২ কোটি ৫০ লাখের বেশি কনটেন্ট মুছে দেয়া হয়েছে, যা কোভিড ও টিকা বিষয়ক তথ্যের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে।

তিনি আরো বলেন যে আর যেসব কনটেন্ট নিম্ন মানের, সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ কমিয়ে দেয় তারা। আর মানুষকে ভুল তথ্যের বিষয় জানাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় ফেসবুক, যাতে পোস্টের সাথে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সূত্র জুড়ে দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশের এ ধরনের কত তথ্য মুছে দেওয়া হয়েছে এ প্রশ্নের উত্তরে অ্যালিস বলেন যে দেশভিত্তিক নির্দিষ্ট তথ্য এই মুহূর্তে তদের পক্ষে বলা সম্ভব না। কারণ তথ্যগুলো ক্রম পরিবর্তনশীল। আবার কোভিড বিষয়ক ভুল তথ্যের ধারণাও সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। কোনো পোস্ট বা ছবি-ভিডিও’র বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা হলে অ্যালিস বলেন এক্ষেত্রে তারা প্রথমে নিজেদের পলিসির সাথে মেলায়।

এরপর থার্ড পার্টির মাধ্যমে যাচাই করা হয়। নীতিমালা লঙ্ঘন করলেই সেটা ফেসবুক সরিয়ে ফেলে। তবে এমন অভিযোগ ও এসেছে যে ফেসবুক কোনকিছু ভালমত যাচাই বাছাই না করেই নীতিমালা ভঙ্গ করেনি এমন সব কনটেন্ট ও সরিয়ে ফেলে। এমনকি রেশারেশি জের ধরে কিছু কনটেন্ট তাদের পছন্দের সাথে না মিললে সরিয়ে ফেলা হতো এমন অভিযোগ ও এসেছে।

জাকারবার্গের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয় সরকারের অভিযোগ

এ মাসেই কিছুদিন আগে আরো একটি অভিযোগের কথা উঠে আসে ফেসবুকের বিরুদ্ধে। একজন নাম গোপন রাখা তথ্য ফাঁসকারী যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন, প্রযুক্তিভিত্তিক সাইট সিনেটের মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়। অস্ট্রেলিয়ায় একটি নতুন আইনের সম্ভাব্য বাস্তবায়ন ঠেকাতে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেশটির সরকারি ও জরুরী স্বাস্থ্যসেবার স্বীকৃত পেজগুলো অচল করে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে। ২০২১ সালের ওই ঘটনায় নিজস্ব কম্পিউটার সিস্টেমের ত্রুটি হিসেবে খবর প্রচার করলেও ফাঁস হওয়া তথ্যমতে বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ছিল।

তখন ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়া সরকার নতুন একটি আইনের প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখছিল। আইনটি কার্যকর হলে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোকে তাদের প্ল্যাটফর্মে শেয়ার হওয়া সংবাদভিত্তিক কনটেন্টের জন্য প্রকাশক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সুবিধা দিতে বাধ্য হতো। অস্ট্রেলিয়ান আইনপ্রণেতাদের চেষ্টা ফেসবুকের একেবারেই পছন্দ হয়নি। যার ফলে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক এবং প্রকাশকদের কনটেন্ট শেয়ার করার পথ ফেসবুক ব্লক করে দিয়েছিল। সে সময় ফেসবুক ওই ঘটনার ব্যাখ্যায় নিজস্ব কম্পিউটার সিস্টেমের ত্রুটিকে দোষ দিয়েছিল।

‘রিয়েল টাইম লোকেশন’ ফিচার বন্ধ করেছে ফেসবুক

কিছুদিন আগে ফেসবুকে রিয়েল টাইম লোকেশন বন্ধ করা প্রসঙ্গে তথ্য উঠে আসে সংবাদ মাধ্যেম। বন্ধ হতে যাওয়া ফিচারগুলোর মধ্যে রয়েছে নিয়ারবাই ফ্রেন্ডস, ওয়েদার অ্যালার্টস, লোকেশন হিস্টরি এবং ব্যাকগ্রাউন্ড লোকেশন। প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট ৯টু৫ গুগল এর প্রতিবেদনে ফিচারগুলো বন্ধের বিষয়টি উঠে এসেছে। ৯টু৫ গুগল এর প্রতিবেদন বলছে যে যারা এসব ফিচার ব্যবহার করেছেন, তাদের কাছে ফেসবুকের তরফ থেকে একটি বার্তা পাঠানো হয়েছে। ৯টু৫ গুগলকে পাঠানো বার্তায় ফেসবুক আগামী ৩১ মে থেকে ফিচারগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডেটা সংগ্রহ বন্ধ করে দেবে এবং ১ আগস্ট থেকে সংরক্ষিত সকল ডেটা মুছে ফেলবে এমনটি জানিয়েছে।

মেটার মতে এসব ফিচারের ব্যবহার কম হওয়ার কারণে মেটা মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যমটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে অনেকেই বলছে লোকেশন ট্র‍্যাকিং এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী ও তার আশেপাশে থাকা ফেসবুক ব্যবহারকারীর ছবি ও ডেটা সংগ্রহ করা বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ আসার ফলে মেটা রিয়েল টাইম লোকেশন ফিচারটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে এমনটি ভেবে মেটা কর্তৃপক্ষ সত্যিটা সামনে আনতে চাননি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.