সম্প্রতি মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির মাধ্যমে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা সম্ভবত কিউ-অ্যানন আন্দোলনের পেছনে মূল সংযুক্ত কিউ এর পরিচয় উন্মোচন করতে পেরেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকান একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার এবং বিশেষ ব্যক্তি ফার্বার এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতি প্রথম তিনিই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। উভয় ফলাফলেই কিউ হিসেবে ফার্বার পলই নামক ব্যক্তিই চিহ্নিত হয়েছেন। মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস শনিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভাষাবিষয়ক অপরাধবিজ্ঞানীদের দুটি আলাদা ও স্বাধীন দলের ফলাফল প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে।
কিউ-অ্যানন হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়ানো কতগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যার মূল কথা শয়তান-উপাসনাকারী শিশু নিপীড়কদের একটি দল এই পৃথিবীটা পরিচালনা করছে। কিউ-অ্যাননভূক্ত অনেকেই বিশ্বাস করে যে শিশু নিপীড়ণের পাশাপাশি এই দলের সদস্যরা নিপীড়ণ করা শিশুদের হত্যা করেন এবং খান। এর মাধ্যমে তারা অ্যাড্রেনোক্রোম নামক একটি জীবনীশক্তিদাতা রাসায়নিক লাভ করেন। এছাড়াও এর অনুসারীরা বিশ্বাস করে যে এই দলে হিলারি ক্লিনটন, জো বাইডেন, জর্জ সোরাস এবং বারাক ওবামার মতো শীর্ষ একদল গণতন্ত্র আছেন।
কিউ-অ্যাননের বাণী আসতো শীর্ষ ব্যক্তি ‘কিউ’-এর কাছ থেকে। ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন ক্যাপিটলে আক্রমণকারীদের একটি বড় অংশ কিউ-অ্যানন অনুসারী ছিল। কিউ-অ্যানন বিশ্বাস অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক জেনারেলরা ডনাল্ড ট্রাম্পকে ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নিয়োগ করেছিলেন যাতে করে তিনি অপরাধচক্র ভেঙে এর সদস্যদের বিচারের আওতায় আনেন। বিচারে এই সদস্যদের মধ্যে অনেক জনকেই শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে, আবার অনেকজনকে গুয়ানতানামো বে এ কারাবন্দী করা হবে, বাকিরা অন্যরা সামরিক ট্রাইবুনালের মুখোমুখি হবে এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
দুটি গবেষণাতেই আরিজোনা অঙ্গরাজ্যে কংগ্রেস প্রার্থী রন ওয়াটকিনসের নামও উঠে এসেছে। তিনি প্রথমে ফার্বারের সঙ্গে সহযোগিতা করেন এবং পরে অ্যাকাউন্টটির দখল নিয়ে নেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তার বাবার প্রতিষ্ঠান এইট-চ্যানের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান অর্ফঅ্যানালিটিক্স এর দুই গবেষকের সমন্বয়ে গঠিত সুইস দলটি সফটওয়্যারের সাহায্যে কিউ এর বাণীতে তিনটি অক্ষরের পূণরাবৃত্তির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন। তারপর তারা বের করেন এই পুনরাবৃত্তি ঘন ঘন ঘটেছে। কিউ-অ্যানন এর পরিচয় উদ্ধারে সুইস এবং ফরাসী গবেষকদের দুটি দল ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
ফরাসি দলটি কিউ-এর লেখার ধরন বের করার জন্য একটি এআইকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ফরাসী দলের কম্পিউটেশনাল ভাষাবিদ ফ্লোরিয়ান কাফিরো এবং জঁ-ব্যাপটিস্ট ক্যাম্পস টাইমসকে বলেছেন যে তাদের সফটওয়্যার ৯৮ শতাংশ ফার্বারের লেখা এবং ৯৯ শতাংশ ওয়াটকিন্সের লেখার ধরন সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছে। কাফিরো বলেন যে শুরুর পোস্টগুলোর বেশিরভাগই এসেছে ফার্বারের কাছ থেকে। কিন্তু কয়েক মাস পরই লেখায় পল ফার্বারের বৈশিষ্ট্য কমতে থাকে ও রন ওয়াটকিন্সের লেখার লক্ষণ বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে ফার্বারের লেখার বৈশিষ্ট্য এদকম হারিয়ে যায়।
উভয় কৌশলই ব্যাপকভাবে স্টাইলোমেট্রি নামে পরিচিত, যেটি গণনযোগ্য, সামঞ্জস্যভিত্তিক এবং প্রতিরূপযোগ্যভাবে লেখার বিশ্লেষণ করে। এরপর শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে যে ফার্বার এবং ওয়াটকিন্সের লেখাই কিউ-এর লেখার ধরনের সবচেয়ে কাছাকাছি। লেখক শনাক্ত করার জন্য এর আগেও মেশিন লার্নিং সফটওয়্যার pp0llব্যবহৃত হয়েছে। ২০১৩ সালের ক্রাইম ফিকশন উপন্যাস কুক্কু’স কলিং এর লেখকের পরিচয় বের করা হয়েছে। এরপর এক সময়ে প্রমাণিত হয় রবার্ট গ্যালব্রাইথ ছদ্মনামের লেখক আসলে হ্যারি পটার খ্যাত জে কে রাউলিং।
কুক্কু’স কলিংয়ের লেখক হিসেবে রাউলিংকে অধ্যাপক ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী প্যাট্রিক জুওলা নিশ্চিত করেছেন। এফবিআই সফলভাবে স্টাইলোমেট্রি ব্যবহার করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে। তিনি এই ফলাফলগুলি বিশ্বাসযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। জুওলা বলেন যে যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো দুটি স্বাধীন বিশ্লেষণের উভয়ই একই লক্ষণ শনাক্ত করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। যদিও কিউ ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে কোনও নতুন বার্তা পাঠায়নি।
এদিকে ফার্বার এবং ওয়াটকিন্স উভয়ই কিউ এর বার্তা লেখার কথা অস্বীকার করেন। ওয়াটকিন্স দাবি করেন যে সে কিউ নন। অপরদিকে ফার্বার বলছেন যে তিনি লেখালেখির ক্ষেত্রে কিউ এর পোস্টে প্রভাবিত হয়েছেন। যদিও ভাষা বিশেষজ্ঞরা এই দাবিকে সরাসরি অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন। গবেষকরা টাইমসকে বলেন যে তারা আশা করেন, কিউ এর গোপন সব তথ্য ফাঁস করার পর মানুষের উপর কিউ-অ্যানন এর নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে।