Reading Time: 4 minutes

বর্তমানে বহুল আলোচিত-সমালোচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক নিয়ে নতুন নতুন অনেক গুঞ্জন অনবরত চলছেই। সম্প্রতি ফেসবুক জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারকারীদের আরও উগ্রপন্থী ভুয়া তথ্য এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদী গ্রুপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফেসবুক অ্যালগরিদম নিয়ে বুধবার সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদন গ্লোবাল উইটনেস প্রকাশ করেছে। উক্ত বিষয়টি একটি মানবাধিকার সংগঠনের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে উঠে এসেছে। তবে ফেসবুক বরাবরই দাবি করে এসেছে, তাদের সিস্টেমগুলো ভুয়া তথ্যের প্রচারণা কমানোর লক্ষ্য নিয়েই নকশা করা হয়েছে।

ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার দাবি, তারা আরও বেশি জলবায়ু বিষয়ক পোস্টে লেবেল জুড়ে দিয়ে কনটেন্ট ফ্ল্যাগ করছে। প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিনিধি এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেন যে আমাদের সিস্টেমগুলো ভুয়া তথ্য কমানোর জন্যই ডিজাইন করা হয়েছে, আরও বড় করে উপস্থাপনের জন্য নয়। এর মধ্যে জলবায়ু নিয়ে ভুয়া তথ্যও আছে। সমস্যাযুক্ত কনটেন্টের বেলায় তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মানুষের হস্তক্ষেপ এবং আমাদের অংশীদারদের অংশগ্রহণের সমন্বয়কে ব্যবহার করি আমরা। এর মধ্যে তথ্য যাচাইকারীরাও আছেন। মেটা প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মিথ্যাচার ও ভুল তথ্যের প্রচারণা মোকাবেলায় কাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১০ লাখ ডলারের তহবিল গঠনের কথাও বলেছিল।

তবে সেন্টার ফর কাউন্টারিং ডিজিটাল হেইট এবং ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ এর সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে যে ফেসবুক নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে থাকা বিভ্রান্তিকর পোস্টগুলোর মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম পোস্টকে ভুয়া তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করে। এ প্রসঙ্গে গ্লোবাল উইটনেস এর গবেষক মাই রোজনার বলেন যে ফেসবুক বারবার বলেছে যে তারা নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভুয়া তথ্য মোকাবেলা করতে চায় কিন্তু আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে যে এই প্লাটফর্মে ব্যবহারকারীদের বিজ্ঞান এবং বাস্তবতার বিরুদ্ধে চালানো খুবই সহজ।

ফেসবুক অনলাইনের কোনো নিরপেক্ষ জায়গা নয় যেখানে কেবল জলবায়ু নিয়ে ভুয়া তথ্যের উপস্থিতি আছে বরং প্ল্যাটফর্মটি সরাসরি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের চোখের সামনে ধরে রাখে। 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটির গবেষণা বলছে যে ফেসবুকের অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের সামনে সঠিক তথ্য উপস্থাপন না করে বরং মানুষের মনের বিভ্রান্তিকেই আরও শক্তিশালী করার মতো কনটেন্টের দিকে ঠেলে দেয়। বিবিসি বলছে যে গবেষকরা গবেষণার স্বার্থে ‘জেন’ এবং ‘জন’ দুটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট বানিয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘জেন’ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ অ্যাকাউন্ট এবং অন্যটি ছিল ‘জন’ যেটি নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিশ্বাস করতো।

এরপর গবেষকরা ফেসবুকের অ্যালগরিদম উভয় অ্যাকাউন্টের কাছে কোন ধরনের কনটেন্ট উপস্থাপন করছে তার হিসাব রাখা শুরু করেন। ভুয়া অ্যাকাউন্ট জেন থেকে ফেসবুকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ায় এমন একটি ফেসবুক পেইজে গবেষকরা লাইক দিয়েছিলেন। এরপর তারা একই ঘটনা আরও দুবার একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করেন। জেন লাইক দিয়েছিল এমন পেইজগুলোর একটি ছিল ‘আই লাভ কার্বন ডাই-অক্সাইড।’ প্রতিবারই লাইক দেওয়া হয়েছে এমন পেইজে যার ফলোয়ার সংখ্যা ছিল অন্তত ১৪ হাজার এবং জলবায়ূ পরিবর্তন বা এর সঙ্গে মানব সভ্যতার সংশ্লিষ্টতা দিয়ে পেইজগুলো সন্দেহ প্রকাশ করে।

অন্যদিকে জন এর অ্যাকাউন্ট থেকে শুরুতেই জাতিসংঘের বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা আইপিসি (ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) এ লাইক দেওয়া হয়েছিল। জেন এর তুলনায় জন বিজ্ঞানভিত্তিক নির্ভরযোগ্য কনটেন্টের সাজেশন পেয়েছেন। এর মধ্যে সবুজ বিপ্লব মানব সভ্যতাকে দাসে পরিণত করছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে এমন পোস্টও আছে বলে বিবিসি জানিয়েছে। ফেসবুকের অ্যালগরিদম জেন কে জলবায়ুর উপর মানবসভ্যতার বিরূপপ্রভাব অস্বীকারকারী কনটেন্ট দেখাতে থাকে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনকে বানোয়াট বলে আখ্যা দেয় এমন গ্রুপও ছিল।

উক্ত ফেসবুক গ্রুপগুলো থেকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন চেষ্টাকে আক্রমণও করা হয়। এমনকি উক্ত কনটেন্টে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তৎপরতার কারণে জাতিসংঘকে কার্টুন চরিত্র বাগস বানির চেয়েও কম বিশ্বাসযোগ্য কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। একই পেইজের আরেকটি পোস্টে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির জ্বালানীর উৎস নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনকে বানোয়াট সঙ্কট বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিবিসি জানিয়েছে, জেনের অ্যাকাউন্টে যতোগুলো পেইজের সাজেশন দেখানো হয়েছিল তার মধ্যে কেবল একটিতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কোনো ভুল বা ভুয়া তথ্য ছিল না।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

গেল বছরেই মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে মার্ক জাকারবার্গ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভুল তথ্যের প্রচারকে একটি বিরাট ইস্যু বলে আখ্যা দেওয়ার পর ফেসবুক ক্লাইমেট সায়েন্স সেন্টার চালু করেছিল। ওই পেইজগুলোর দুই-তৃতীয়াংশে ফেসবুকের ক্লাইমেট সায়েন্স সেন্টার এর কোনো লেবেলও ছিল না বলে জানিয়েছে বিবিসি। অন্যান্য কনটেন্টের মধ্যে সিফ্যাক্ট ক্যাম্পাস এর পোস্ট রয়েছে। উক্ত ফেইসবুক গ্রুপটি জলবায়ুর উপর মানব সভ্যতার বিরূপ প্রভাব সরাসরি অস্বীকার করে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক কমিটি ফর এ কনসট্রাক্টিভ টুমরো এর অংশ।

গ্রুপটি স্বীকৃত জলবায়ু গবেষণাকে অস্বীকার করে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল গোর জলবায়ূ গবেষকদের পাওয়া তথ্য উপাত্তের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন যে আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে গ্রীস্মকালের কয়েক মাসের জন্য উত্তরমেরু বরফ মুক্ত থাকার সম্ভাবনা ৭৫ শতাংশ। বিবিসি বলছে যে এক্ষেত্রে জলবায়ু গবেষকদের তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হলেও ২০১৩ সালের মধ্যে সব বরফ গলে যাবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী ছিল না এটি। পরের বছরগুলোতে আল গোর এমন দাবি বা বক্তব্য কোনোটাই দেননি।

গবেষণা চলমান অবস্থায় ফেসবুক অ্যালগরিদম জেন কে আরও উগ্রপন্থী কনটেন্টে দেখাতে থাকে বলে বিবিসি জানিয়েছে। জেন এর সাজেশনে ষড়যন্ত্র তত্ত্বও এসেছে। ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আগ্রহ দেখালেই ফেসবুকের অ্যালগরিদম তাকে শেষ অবধি একদম উগ্রপন্থী কনটেন্টে নিয়ে যাচ্ছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আইপিসিসি বলছে যে সরকার এবং জনগনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বেলায় যে বিষয়গুলো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভুয়া তথ্যের প্রচারণা।

কোভিড-১৯ নিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচার আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজেদের তৎপরতা নিয়ে মেটা বিনিয়োগকারীদের ভুল তথ্য দিচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে নতুন দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট সিনেট এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায় যে ফেব্রুয়ারী মাসেই নতুন অভিযোগ দুটি আনা হয়েছিল। মেটার বিরুদ্ধে নতুন যে দুটি অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে ফেসবুক কর্মচারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক সঙ্কট সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্যের প্রচার বন্ধে নিজেদের প্রতিশ্রুতির কথা বললেও তার কিছুই তারা করেনি।

প্ল্যাটফর্মটিতে এ ধরনের মিথ্যা প্রচারের উপস্থিতি বিপুল পরিমাণে উপস্থিত ছিল। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সংগঠনটি বলছে ফেসবুকের কর্মকর্তারা কোভিড মহামারী সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ও মিথ্যাচার প্রচার বারবার মুছে দেওয়ার কথা বললেও প্রতিষ্ঠানটি অভ্যন্তরীণ নথিপত্র বলছে প্ল্যাটফর্মটিতে ব্যাপক হারে কোভিড নিয়ে মিথ্যাচার এখনো অধিক পরিমাণে ছড়িয়ে আছে। সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এর কাছে হুইসেলব্লোয়ার এইড নামের একটি অলাভজনক সংগঠন নতুন অভিযোগ দুটি এনেছে। সংগঠনটি অভিযোগ করেছে যে মেটা তথ্য এবং উপাত্ত ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে এবং বিনিয়োগকারীদের দেওয়া প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেপে গেছে।

মেটার তথ্য ফাঁসকারী সেই সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন সংগঠনটি প্রতিনিধিত্ব করছেন। হুইসেলব্লোয়ার এইড এসইসি এর কাছে নতুন অভিযোগ দায়ের করার খবর নিশ্চিত করেছে। প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনিয়োগকারীদের সঠিক তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে বলে সংঘঠনটি মন্তব্য করেছে। ফেসবুক ও তার প্রতিষ্ঠান গত বছর থেকেই বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ভুয়া তথ্য, কোভিড মিথ্যাচার মোকাবেলাসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফেসবুক যথেষ্ট হেয়ালিপনা করে যাচ্ছে এমন অভিযোগ বেশ কয়েকদিন ধরেই চলে আসছে। সমস্যাগুলো সমাধানের আশ্বাস দেয়ার পর ও তার কিছুই এখনো হয়নি।

২০২১ সালে হাউগেন ফেসবুক প্রতিষ্ঠান মেটা সম্পর্কে গোপন সব তথ্য ফাঁস করেছিলেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র হাউগেনের কাছ থেকে পাওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তখনও মেটা তাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অস্বীকার জানায়।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.