Reading Time: 4 minutes

ইন্টারনেট প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরশীলতা এবং সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর মার্ক জাকারবার্গ ও ইলন মাস্কের মত প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য মানব সমাজের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলছে বলে আশঙ্কা করছেন ভার্চুয়াল রিয়ালিটি শব্দগুচ্ছের প্রবর্তক এবং এই প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেরন ল্যানিয়ার। সোশ্যাল মিডিয়া প্রযুক্তিকে মানবসভ্যতা বিলুপ্তির হুমকির বিশেষ কারন হিসেবে দেখছেন তিনি।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম টুইটার নিয়ে সাম্প্রতিক উন্মাদনার প্রসঙ্গ টেনে অনলাইনের সাইকোলজিকাল এজেন্টদের থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সামাজিক মাধ্যম প্রযুক্তির ওপর বর্তমান সমাজের অতিনির্ভরশীলতা নিয়ে জেরন ল্যানিয়ারের শঙ্কা পুরোনো। গত কয়েক মাসে টুইটার নিয়ে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা আর সর্বপরি ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থায় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ভুয়া তথ্যের প্রচার ক্রমাগত বৃদ্ধি সার্বিক পরিস্থিতির অবনতির দিকে নজর টানছে বলে মত তার।

বর্তমান প্রযুক্তি শিল্পে শঙ্কিত হওয়ার জন্য বিপজ্জনক বিষয়ের অভাব নেই এবং সেগুলো মানবসভ্যতার জন্য বিলুপ্তির হুমকি বলে দ্যা গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন তিনি। ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি আর ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের মুনাফার লোভে সেবাগ্রাহকের মানসিক সুস্থতা অগ্রাহ্য করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে আগে থেকেই। তিনি বলেন, মানুষ টিকে আছে একে অন্যের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করে।

মানবতার সেই মৌলিক গুণটিকে এমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে দুর্নীতি আর অবক্ষয় পুরস্কৃত। এ সময়ের মৌলিক নাটকীয়তার বিষয়বস্তু হচ্ছে এই উপাদানগুলো নিয়েই সঠিকভাবে বাঁচা সম্ভব কি না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইলন মাস্কের টুইটারে জুড়ে বসার সফল অপচেষ্টার ওপর বাড়তি গুরুত্বারোপ নতুন মাত্রা যোগ করেছে সে শঙ্কায়। এ ছাড়াও ইন্টারনেটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষে সক্রিয় মনস্তাত্ত্বিক এজেন্টদের নিয়েও সতর্ক করে দিয়েছেন জেরন ল্যানিয়ার।

এরা প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য তথ্য-উপাত্ত সম্পাদনা এবং প্রচারণার কাজ করছে। অল্প কথায় বললে, শুরুর দিনগুলোতে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা তথ্যের মুক্তাঙ্গন হিসেবে যে ইন্টারনেট ব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন, বর্তমান বাস্তবতা তার পুরোপুরি উল্টো। জেরন ল্যানিয়ারের মতে, পুরো ব্যবস্থাটি নীতিগত জায়গা থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ক্রমাগত এর অপব্যবহার চলছে। তিনি আরো বলেন, এখানে নানা রকমের মধ্যস্বত্ত্বভোগী আছে। প্ল্যাটফর্মের মালিকানা যাদের হাতে তারাও হতে পারেন।

সাম্প্রতিক সময়ের ইলন মাস্ক বা এমন কোনো তৃতীয় পক্ষ যারা মানুষকে প্রভাবিত করতে সিদ্ধহস্ত। মাঝে নাক গলানোর মানুষগুলো নানা রকমের হতে পারে। কেউ সরকারি কর্মকর্তা, কেউ জনসমক্ষেই কাজ করেন, কেউ বা লুকিয়ে। এদের কেউ কেউ নিজের কাজে যোগ্য, কেউ একেবারেই অযোগ্য, বিষয়টা এমন যে, একজন এমন একটা অ্যালগরিদম বানিয়েছেন যা তিনি নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না। এ পরিস্থিতির ঝুঁকি কোনো বিবেচনাতেই কম নয়।

তিনি এখনও মনে করেন অন্তিম ফলাফল হিসেবে মানবসভত্যার বিলুপ্তিকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। যদি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজেদের সমন্বয় করতে পারি তবে সেটা হবে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত যে আমরা সমাজ হিসেবে এখনও পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়িনি গার্ডিয়ানকে বলেছেন জেরন ল্যানিয়ার। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘ইউ আর নট এ গ্যাজেট: এ ম্যানিফেস্টো’ বইয়ে ওয়েব মতাদর্শ নিয়ে এবং সেবাগ্রাহকদের হাইভ মাইন্ড নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন জেরন ল্যানিয়ার।

এই দুইয়ের সংমিশ্রণ সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কার কথা বলেছিলেন বইয়ে। পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র ব্যাখ্যা করে জেরন ল্যানিয়ার গার্ডিয়ানকে বলেন, এমন একটা যুগে প্রবেশ করছি যেখানে আসলে কোনো কিছুরই কোনো মানে নেই, সবকিছুই ক্ষমতা, মধ্যস্থতা এবং প্রভাব বিস্তারকেন্দ্রীক। নতুন কোনো ভাবনার প্রচার যেমন কঠিন, তেমনি ভুল উপস্থাপনাও খুবই সহজ। তিনি এটি বিশ্বাস করেন যে এমন সব মানুষ আছেন যারা অনলাইনে অপারেন্ট কন্ডিশনিংয়ের শিকার হচ্ছেন।

অর্থাৎ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই হচ্ছে মানুষের। স্বীকৃতি, অস্বীকৃতি, উপেক্ষার মতো কৌশলগুলোর কলকাঠি নেড়ে মানুষের মধ্যে আসক্তি বপন করা হচ্ছে যা পুরো সমাজকেই প্রভাবিত করছে এবং যার বর্ণনা দিতে গালভরা এনগেজমেন্ট শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে জেরন ল্যানিয়ার লিখেছেন, টুইটার ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম নিয়মিত ব্যবহার করেন এমন মানুষদের জনসমক্ষে আচরণে পরিবর্তন চোখে পড়েছে তার।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

এক সময় জনসাধারণের কাছে সমাদৃত হলেও এদের প্রত্যেকেই জন জীবনে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করে যাচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি। এ পরিস্থিতি অপারেন্ট কন্ডিশনিং প্রক্রিয়ারই ফলাফল বলে মনে করেন জেরন ল্যানিয়ার এবং একে ‘টুইটার পয়জনিং’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন তিনি। সরাসরি ইলন মাস্ক, ডনাল্ড ট্রাম্প এবং কানিয়ে ওয়েস্টের নাম ও উল্লেখ করেছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসে জেরন ল্যানিয়ার লিখেছিলেন, “আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, এই মানুষগুলোর আচরণ একই রকমের ব্যক্তিত্বে পরিবর্তিত হচ্ছে যা আগে ছিল না।”

এর সঙ্গে সামাজিক মাধ্যম আসক্তির সম্পর্ক আছে, অথবা টুইটার পয়জনিং। বিভিন্ন সময় নিজেকে শঙ্কিত আশাবাদী বলে পরিচয় দিয়েছেন জেরন ল্যানিয়ার। তার মতে, এতো শঙ্কার মধ্যেও তার আশা তিনি ভুল প্রমাণিত হবেন। তিনি বলেন, যদি নৈরাশ্যবাদী ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং সেটা সত্যি হয় তবে তার মানে হচ্ছে আপনি নিজে কোনো কাজেই আসেননি। তিনি কখনোই দাবি করেন না যে কাছে সব জবাব আছে তার কাছে; তবে এটি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে তার টিকে থাকার বিষয়টি ইন্টারনেট সংস্কারের ওপর নির্ভর করছে।

তবে এ প্রযুক্তি গবেষকের মতামত যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে বলে মন্তব্য করেছে দ্যা গার্ডিয়ান। দ্যা গার্ডিয়ানকে তিনি জানান, এমন একটা কাঠামো তৈরি করতে হবে যা মানুষের চেতনার জন্য বন্ধুসুলভ এবং মানুষ সত্যিই যেমন তার প্রতিফলন হয়। ইতিহাসের পুরোটা জুড়েই মানুষ নানা নেতিবাচক কাজ করেছে, তাই বিদ্যমান অকার্যকর পরিস্থিতির মধ্যে কার্যকারণ নির্ভর যোগসূত্র টানা বেশ কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মতো মানসিক সুস্থতা ধরে রেখে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের কাজ করতে পারবো কি না।

যারা সহযোগিতা করতে চান তারাও হয়তো সাহায্য করতে পারবেন না। কারণ, তারা এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছেন যেখানে তাদের প্রত্যাশা মতো তাদের কথায় কেউ কান দিচ্ছেন না। এখন সে আত্মবিশ্বাসই নেই যে, জেরন ল্যানিয়ার এর মত যারা যা বলছেন তা কেউ সঠিকভাবে শুনবেন। প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরশীলতা এবং সামাজিক মাধ্যম প্রযুক্তির সমালোচক হিসেবে আগে থেকে সুপরিচিতি আছে জেরন ল্যানিয়ারের। একাধারে কম্পিউটার বিজ্ঞানী, কম্পোজার, ভিজুয়াল আর্টিস্ট, কম্পিউটার দর্শনের লেখক তিনি।

৮০ এর দশকে প্রযুক্তি দুনিয়ায় ভার্চুয়াল রিয়ালিটি প্রযুক্তির অভিষেকও হয়েছিল তার হাত ধরেই। পেশাজীবনের বিভিন্ন সময়ে গেইমিং কনসোল নির্মাতা আতারি থেকে শুরু করে গবেষক ও প্রকৌশলীদের জোট ইন্টারনেট ২ কনসোর্টিয়াম এবং প্রথমসারির একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে কাজ করছেন টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফটের গবেষণা দলের সঙ্গে। পেশাজীবনের পুরোটা জুড়েই কম্পিউটার কোডের এক আর শূন্যের বাইরের দুনিয়ার দিকে নজর রেখেছেন জেরন ল্যানিয়ার।

আধুনিক ওয়েব ২.০ মান নির্মাণে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। “ডিজিটাল ইউটোপিয়া” ভাবনা ছিল তার কর্মজীবনের কেন্দ্রে। কিন্তু, বর্তমান দৃশ্যপটে সেই ডিজিটাল ইউটোপিয়া নিয়ে আগের মতো আশাবাদী নন জেরন ল্যানিয়ার। বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল ইউটোপিয়ার বদলে “ডিজিটাল মাওইজম” বিরাজ করছে বলে মনে করেন এ কম্পিউটার বিজ্ঞানী। জেরন ল্যানিয়ারের চোখে ফেসবুক আর গুগলের মতো কোম্পানিগুলোর ভূমিকা কল্পবিজ্ঞান গল্পের স্পাই এজেন্সির মতো।

আর সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর অতিনির্ভরশীলতা নিয়ে প্রথম থেকেই কঠোর সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন জেরন ল্যানিয়ার। তার ভাষায়, বিড়াল নিয়ে আদুরে ভিডিও আর গৃহযুদ্ধ, উভয়ই পাওয়া যাবে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.