শরণার্থীদের থাকা-খাওয়া এবং জীবনধারনের মৌলিক খরচ মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য পাঠিয়ে সহযোগিতা করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইএনএইচসিআর। এবার ইউক্রেন যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের ক্রিপ্টো মুদ্রা ইউএসডি কয়েন বা ইউএসডিসি এর মাধ্যমে অর্থ সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু অস্থিতিশীল ক্রিপ্টোবাজারের বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে এর যৌক্তিকতা নিয়ে। বৃহস্পতিবারে ইএনএইচসিআর সংস্থা ঘোষণা দেয়, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের ভুক্তভোগীদের ক্রিপ্টো মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ সাহায্য দেওয়া হবে।
বিশ্বের যে কোনো জায়গায় মানিগ্রাম সেবার মাধ্যমে সংস্থাটির পাঠানো ক্রিপ্টো মুদ্রা বদলে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে শরণার্থীরা। ইউএনএইচসিআরের এ উদ্যোগের সমর্থকরা বলছেন, এ প্রক্রিয়ায় আরও দ্রুত অর্থ সাহায্য পাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ। তহবিল হাতবদলের সময় তছরুপ হওয়ার শঙ্কা কমে আসবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। ইউএসডিসি স্টেবল কয়েন হিসেবে পরিচিতি।
অর্থাৎ, ক্রিপ্টো মুদ্রাটির মূল্যায়ন হয় মার্কিন ডলারের সঙ্গে সমন্বয় করে। মূল ধারার মুদ্রা ব্যবস্থার সমর্থনের কারণে তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত স্টেবল কয়েনগুলো। ওয়াশিংটন পোস্ট আরো জানায় যে, এতে শরণার্থীদের সহযোগিতা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় বাড়তি একটি ধাপ যোগ হবে বলে মনে করছেন সমালোচকরা। অন্যদিকে বছুরজুড়ে বৈশ্বিক ক্রিপ্টো বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে বাড়তি জটিলতা তৈরি হওয়ার শঙ্কাও আছে।
জাতিসংঘের এ উদ্যোগ নিয়ে ক্রিপ্টো খাতের সমালোচক মলি হোয়াইটের ভাষ্য, তারা সরাসরি মানুষকে ক্রিপ্টো লেনদেনে অংশ নিতে বলছে। কিন্তু সার্বিক ক্রিপ্টো খাতের কিছু অংশে যে বড় ঝুঁকি আছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন হোয়াইট। এই সেবা পেতে যে ওয়ালেট ডাউনলোড করতে হবে, তা শরণার্থীদের ক্রিপ্টো জগতের নানা ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন হোয়াইট। ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্রিপ্টো ওয়ালেট সবসময় গ্রাহককে দিয়ে আরও বেশি ক্রিপ্টো মুদ্রা কেনাতে চায়।
এতে শরণার্থীরা সাহায্যের অর্থ বিটকয়েনের মত অন্যান্য ক্রিপ্টো মুদ্রায় বিনিয়োগ করে বসতে পারেন। আর দিন শেষে তা জুয়ায় পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা হোয়াইটের। এ পরিস্থিতিতে ক্রিপ্টো মুদ্রা কোম্পানিগুলোই লাভবান হবে বলে তিনি মনে করেন। শরণার্থীদের হাতে সহযোগিতার অর্থ যাওয়ার গুরুত্ব স্বীকার করে তিনি বলেন, এতে আসলে মানুষকে সহযোগিতা করা হচ্ছে না। ইউক্রেনের শরণার্থীদের কত অর্থ পাঠানো হচ্ছে আসলে তা নয়, বরং স্টেবলকয়েনের ব্যবহার দেখানো বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
সমালোচনা প্রসঙ্গে ইউএনএইচসিআরের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে পারেনি ওয়াশিংটন পোস্ট। বছরজুড়ে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে বৈশ্বিক ক্রিপ্টোবাজারে, গত কয়েক মাসে আরও অবনতি হয়েছে সার্বিক পরিস্থিতির। কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে শীর্ষস্থানীয় ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ এফটিএক্স। জালিয়াতি ও অর্থপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহী স্যাম ব্যাঙ্কম্যান-ফ্রিড। তবে ক্রিপ্টো মুদ্রায় অর্থ সাহায্য পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার সময় ইউক্রেনে ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি ক্যারোলিনা লিন্ডহোম বিলিং বলেন, মানবসেবামূলক কাজের ক্ষেত্রে গতির আলাদা গুরুত্ব আছে।
এছাড়া মানুষকে সহযোগিতা পাওয়ার একাধিক মাধ্যম দেওয়ারও আলাদা গুরুত্ব আছে। সবার জন্য এক জিনিস খাটে না। অন্যদিকে ব্যাপক হারে দর হারিয়েছে ক্রিপ্টো বাজারের শীর্ষ মুদ্রা বিটকয়েন। এক সময়ে স্থিতিশীল হিসেবে বিবেচিত ক্রিপ্টো মুদ্রা টেরাইউএসডি এর দাম নেমে এসেছে দশমিকের পরে আরও তিনটি শূন্যের নিচে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই দৃশ্যপটে ক্রিপ্টো মুদ্রার প্রাসঙ্গিকতা ছিল লক্ষণীয়। যুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতেই ক্রিপ্টো মুদ্রার মাধ্যমে প্রায় ১০ কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছিল ইউক্রেন সরকার।
জাতিসংঘের অর্থ সাহায্য পেতে বাস্তুচ্যুত মানুষদের প্রথমে স্মার্টফোনে ‘ভাইব্রেন্ট’ নামের একটি ভার্চুয়াল ওয়ালেট অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে। অর্থ সাহায্য ইউএসডিসি হিসেবে প্রথমে ওই অ্যাপের অ্যাকাউন্টে আসবে। তারপর সেই ক্রিপ্টো মুদ্রার বদলে ইউরো বা ডলার সংগ্রহ করতে পারবেন শরণার্থীরা। এখন কিইভ, লেভিভ এবং ভিনিতসিয়া শহরগুলোতে ক্রিপ্টো মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ সাহায্য দেওয়ার পাইলট প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ।
ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, ছয় মাস ধরে ভুক্তভোগীদের মধ্যে এই প্রযুক্তি সেবার ব্যবহার উপযোগিতা যাচাইয়ের দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু জাতিসংঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কতোটা সাফল্য পেয়েছে সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, ইউএসডিসি স্টেলার ব্লকচেইন নির্ভর ক্রিপ্টো মুদ্রা। এর প্রোগ্রাম লিখেছে স্টেলার ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, যার মূল কাজই হচ্ছে স্টেলার ব্লকচেইন নিয়ে প্রচার চালানো।
সংস্থাটির কর্মকর্তাদের দাবি, ভৌগলিক সীমাবদ্ধার কারণে তাদের মানবসেবামূলক কর্মকাণ্ড সীমিত ছিল। কিন্ত ক্রিপ্টো মুদ্রার মাধ্যমে তার পরিধি বাড়ানো সম্ভব হবে। ইউক্রেন সরকারের কর্মকর্তারা অবশ্য জাতিসংঘের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেশটির ডিজিটাল রূপান্তরবিষয়ক উপমন্ত্রী ওলেক্সান্ডর বর্নিয়াকভ বলেছেন, প্রাণ বাঁচাতে পালানো ইউক্রেনিয়ানদের জন্য এবং বিশেষ করে যাদের ব্যাংকে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাদের টিকে থাকার জন্য শেষ সম্বল হিসেবে কাজ করতে পারে এটি।