আরো একটি অভিযোগের কথা উঠে এসেছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি একজন তথ্য ফাঁসকারী যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন তথ্য, যেটি প্রযুক্তিভিত্তিক সাইট সিনেটের দেখার সুযোগ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় একটি নতুন আইনের সম্ভাব্য বাস্তবায়ন ঠেকাতে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেশটির সরকারি ও জরুরী স্বাস্থ্যসেবার স্বীকৃত পেজগুলো অচল করে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে। ২০২১ সালের ওই ঘটনায় নিজস্ব কম্পিউটার সিস্টেমের ত্রুটিকে দোষারোপ করলেও ফাঁস হওয়া তথ্যমতে বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ছিল।
সিনেট জানিয়েছে যে ফেসবুকের দিক থেকে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের শঙ্কায় নাম গোপন রেখেছেন তথ্য ফাঁসকারী ব্যক্তি। উল্লিখিত দুই সরকারের কাছে লিখিত বক্তব্য পৌঁছেছে মার্চ ও এপ্রিলে। সিনেট জানিয়েছে যে ওই তথ্য ফাঁসকারীর দায়ের করা নথিপত্রে ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ আলাপচারিতার সংক্ষিপ্তসারও রয়েছে। সংবাদ প্রকাশকদের কনটেন্টে ব্লক করার পাশাপাশি ফেসবুক ইচ্ছে করেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যেন অস্ট্রেলিয়ার সরকারি ও স্বাস্থ্যসেবার পেজগুলোতে প্রবেশাধিকার না পান দেশটির ব্যবহারকারীরা এমনটি বলা হয়েছে অভিযোগে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়া সরকার নতুন একটি আইনের প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখছিল। আইনটি কার্যকর হলে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোকে তাদের প্ল্যাটফর্মে শেয়ার হওয়া সংবাদভিত্তিক কনটেন্টের জন্য প্রকাশক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সুবিধা দিতে বাধ্য হতো। অস্ট্রেলিয়ান আইনপ্রণেতাদের চেষ্টা ফেসবুকের একেবারেই পছন্দ হয়নি। যার ফলে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ, নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক এবং প্রকাশকদের কনটেন্ট শেয়ার করার পথ ফেসবুক ব্লক করে দিয়েছিল। সে সময় ফেসবুক ওই ঘটনার ব্যাখ্যায় নিজস্ব কম্পিউটার সিস্টেমের ত্রুটিকে দোষ দিয়েছিল।
গত বছরেও এক তথ্য ফাঁসকারী সাবেক কর্মীর কারণে ফেসবুক বিপদে পড়েছিল। প্ল্যাটফর্মটির সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন যুক্তরাষ্ট্রের এক সিনেট কমিটি ও যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে মুনাফার লোভে ফেসবুক সাধারণ ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্য একেবারেই অগ্রাহ্য করে চলে। নিজের অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও আলাপচারিতার কপিও জমা দিয়েছিলেন তিনি। ফেব্রুয়ারির দিকে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এর কাছে হুইসেলব্লোয়ার এইড নামের একটি অলাভজনক সংগঠন দুটি অভিযোগ করে।
সংগঠনটি অভিযোগ করেছে যে মেটা তথ্য এবং উপাত্ত ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে এবং বিনিয়োগকারীদের দেওয়া প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেপে গেছে। সংগঠনটি প্রতিনিধিত্ব করছেন মেটার তথ্য ফাঁসকারী সেই সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন। নিজের অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও আলাপচারিতার কপিও জমা দিয়েছিলেন। হুইসেলব্লোয়ার এইড এসইসি এর কাছে নতুন অভিযোগ দায়ের করার খবর নিশ্চিত করেছে। প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনিয়োগকারীদের সঠিক তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে বলে সংঘঠনটি মন্তব্য করেছে।
বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং মিথ্যাচার মোকাবেলায় ফেসবুক যথেষ্ট হেয়ালিপনা করে যাচ্ছে এমন অভিযোগ বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে। ২০২১ সালে হাউগেন ফেসবুক প্রতিষ্ঠান মেটা সম্পর্কে গোপন সব তথ্য ফাঁস করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সব কূকর্ম, কর্মীদের উপর নির্যাতন, মুনাফার লোভে ব্যবহারকারীদের ভালো-মন্দ ব্যাপারে গুরুত্ব না দেয়াসহ আরো নানান রকম অজানা তথ্য এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এরপর থেকেই মেটার খারাপ সময় শুরু। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র হাউগেনের কাছ থেকে পাওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
কিন্তু ফেসবুক দাবি করে আসছে অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ভুলভাবে উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটির জনপ্রিয়তাকে তারা নষ্ট করতে চাচ্ছে। শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটির একজন নির্বাহী দাবি করেন যে তার প্রতিষ্ঠান ভুয়া তথ্যের প্রচার বন্ধে বদ্ধপরিকর এবং তাদের প্রতিষ্ঠান স্বাধীন তথ্য যাচাইকারীদের সঙ্গে কাজ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির দাবি যে ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে তাদের ৪০ হাজার কর্মী কাজ করছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি এই খাতে এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের দাবিও করেছে। এছাড়া মেটা বলে মিথ্যা তথ্যের প্রচার বন্ধে সার্বিকভাবে প্রযোজ্য এমন একক কোনো সমাধান নেই।
দুই তথ্য ফাঁসকারীর বক্তব্য থেকেই ফেসবুকের আক্রমণাত্মক এবং ক্ষেত্রবিশেষে ধোঁকামূলক কৌশল অবলম্বনের প্রবণতা উঠে এসেছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনপ্রতিনিধিরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমবর্ধমান স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ফেসবুকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিজেদের ভুল স্বীকার করে শোধরানোর চেষ্টা করার স্বদিচ্ছা আদৌ আছে কি না, সে প্রশ্নে বিভিন্ন ঘটনায় ফেসবুকের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন হারিয়ে গিয়েছে। নতুন অভিযোগ বলছে যে ফেসবুক একটি দেশের সরকারের ওপর নিজের ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করেছে।
ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডার জনপ্রতিনিধিরা অস্ট্রেলিয়ায় প্রস্তাবিত আইনের সঙ্গে মিল আছে এমন নীতিমালা গঠনের কথা ভাবছিলেন। ৬৭ পাতার ওই নথিতে ফেসবুকের সকল নিউজ কনটেন্ট মুছে দেওয়ার গোপন পরিকল্পনাও উঠে এসেছে। নিজ বক্তব্যে উক্ত তথ্য ফাঁসকারী বলেছেন যে অস্ট্রেলিয়ায় নিউজ কনটেন্ট ব্লক করার সময় ফেসবুক কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেনি। তিনি সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে ফেসবুক অস্ট্রেলিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনার সময় বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জন্য দেশটির রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে।
মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে নথির একাংশ উঠে এসেছে। তথ্য ফাঁসকারীর বক্তব্যে আরো উঠে এসেছে যে অন্তত তিনজন ফেসবুক কর্মী সংবাদ প্রকাশকদের পেজ ছাড়াও সরকারি পেজ ব্লক করা প্রসঙ্গে শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে উক্ত কর্মীরা নিজেরা তৎপর হয়ে ভুলবশত ব্লক হওয়া জরুরী ও সরকারি সেবার পেজগুলো আনব্লক করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন ওই কর্মীরা। তবে, অস্ট্রেলিয়ায় সংবাদ প্রকাশকদের পেজ ব্লক করার দায়িত্বে থাকা দলটি কর্মীদের শঙ্কা ও চেষ্টাকে অগ্রাহ্য করে গেছে বলে অভিযোগ আসে।
তথ্য ফাঁসকারীর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এখনও উন্মুক্ত নয়। উক্ত তথ্য ফাঁসকারী যুক্তরাষ্ট্রের বিচারবিভাগকে অভিযোগ তদন্ত করার তাগাদা দিয়েছেন। সিনেট বলছে যে মার্কিন কংগ্রেসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাদের ওই নথি সরবরাহ করেছেন। ৫ই মে মেটা মুখপাত্র এরিন মিলার ইমেইলে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন যে তথ্যফাঁসকারীর নথিপত্র স্পষ্টভাবেই দেখাচ্ছে যে একটি বিভ্রান্ত ও ক্ষতিকর আইনের প্রভাবে সৃষ্ট বিধিনিষেধ থেকে তারা অস্ট্রেলিয়ার সরকারি পেজগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। যখন কারিগারি ত্রুটির কারণে সেটি করা সম্ভব হয়নি, তখন ক্ষমা চেয়ে নিয়ে সমাধানের জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিপরীতমুখী যে কোনো অভিযোগ শ্রেফ মিথ্যা। এরিন মিয়ার এর বেশি কিছু ব্যাখ্যা দিতে রাজি হননি। তথ্য ফাঁসকারীদের সহায়তা দাতা হুইসেলব্লোয়ার এইড থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিনেট বলছে যে এবার তথ্য ফাঁসকারী সম্ভবত একাধিক। সংস্থাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো নথিপত্রে বলেছে, ফেসবুক একটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জেনেশুনে এবং ইচ্ছে করে অস্ট্রেলিয়ার জরুরী সেবা, স্বাস্থ্য সেবাসহ সরকারের অনলাইন সেবা ব্লক করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছুকে লক্ষ্য করে, সেটি কোনো নীতিগত সুবিধা আদায় হতে পারে।