Reading Time: 5 minutes

সম্প্রতি টেসলা নির্মাতা ইলন মাস টুইটারের প্রধান হিসেবে আসন নেয়ার পর থেকেই দায়িত্ব গ্রহণের চুক্তির অংশ হিসেবে টুইটার বোর্ডের নয়জন সদস্য প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আর নিজের মতে চলা ইলন মাস্ককে একমাত্র পরিচালক হিসেবে রেখে গিয়েছেন। যারা চলে গিয়েছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন চেয়ারম্যান ব্রেট টেলর এবং প্রধান নির্বাহী পরাগ আগারওয়াল। প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা নেড সেগালসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরাও টুইটার ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে পোস্ট করেছেন, বা এরইমধ্যে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।

টুইটারে কর্মী অপসারণ

মার্কিন মিডিয়া বলছে, এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা চলে যাওয়ার সাথে সাথে ইলন মাস্কের অনেক সহযোগী টুইটারে যোগ দিয়েছেন। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে টুইটার কোম্পানির উপর মাস্কের নিজের ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ আরো জোড়ালো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিবিসি লিখেছে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিদায় করে দিলেও মাস্ক নিজে হয়ত এখন প্রধান নির্বাহীর পদে বসছেন না। তবে কোম্পানি যে এখন পুরোপুরি ইলন মাস্ক এর নিয়ন্ত্রণে, তা নিশ্চিত।

সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাটি তাদের এক অভ্যন্তরীণ ইমেইলে বলেছে যে টুইটারের ভালোর জন্য কর্মী অপসারণ করা হবে। ইলন মাস্ক টুইটারের দায়িত্ব নেয়ার পর সেখানে কর্মরত কাউকে অপসারণ করা হবে কিনা, সে ব্যাপারে শুক্রবার সব কর্মীদের অবহিত করা হবে বলে টুইটার জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এর অফিসগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে। আর কর্মীরাও যতক্ষণ না জানতে পারছে যে চাকরি হারিয়েছে কি-না, ততক্ষণ অফিস ভবনে প্রবেশ করতে পারবে না।

অফিসের সকল কর্মী “ইওর রোল অ্যাট টুইটার” বিষয়ে শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টার (জিএমটি ৪টা) এর মধ্যে একটি ইমেইল পাবেন। যাদের চাকরিতে এটির প্রভাব পড়বে না, তাদেরকে অফিসিয়াল ইমেইলের মাধ্যমে জানানো হবে, বলছে টুইটার। অন্যদিকে যাদের চাকরি চলে যাবে, তাদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ‘পরবর্তী পদক্ষেপ’ সম্পর্কে জানানো হবে। টুইটার সেই ইমেইলে বলেছে, সামনের শুক্রবার তারা বিশ্বব্যাপী টুইটার কর্মী সংখ্যা কমিয়ে আনার কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া হতে পারে।

ইমেইলে আরো বলা হয়েছে, যে টুইটারের পেছনে যারা মূল্যবান অবদান রেখেছেন, তাদের অনেকের ওপর এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু কোম্পানিটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে এমন দুর্ভাগ্যজনক পদক্ষেপটি নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক কর্মীদের নিরাপত্তা ও টুইটার সিস্টেম এবং গ্রাহকদের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অফিস প্রবেশাধিকার তাৎক্ষণিকভাবে সীমিত করা হবে বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের এই প্লাটফর্মটি মুনাফা আয় করতে এখনো হিমশিম খাচ্ছে।

তাই এক্ষেত্রে বেতন-ভাতা কমানো একটি সমাধান বলে এটি মনে করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্লুমবার্গ বলেছে যে কিছু সিনিয়র কর্মীদের বলা হয়েছে তাদের নিজ নিজ দলে থাকা কর্মীদের অপসারণের তালিকা তৈরি করতে।

কর্মী অপসারণের অবৈধ পদক্ষেপে অভিযোগ মামলা

এদিকে যথেষ্ট এবং যথাযথ নোটিশ না দিয়ে কর্মরত অর্ধেক কর্মীকে অপসারণের পরিকল্পনা করায় টুইটারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কোম্পানিটির কর্মীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার আইন না মেনে টুইটার গণঅপসারণ করতে যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার শ্রম আইন অনুযায়ী, গণঅপসারণের ৬০ দিন আগে কর্মীদের নোটিশ দিতে হবে। আর সেটি টুইটার করেনি। একটি সাক্ষাৎকারে মামলার বাদি পক্ষের আইনজীবী শ্যানন লিস-রিয়োরদান বলেন, এই মামলা দায়ের করা হয়েছে যাতে কর্মীরা বুঝতে পারে যে তাদের অধিকার বিলিয়ে দেওয়া উচিত হবে না।

মামলার ব্যাপারে টুইটারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। টুইটারের কর্মী অপসারণ নোটিশ দেয়ার পর যুক্তরাজ্যে টুইটারের একজন সিনিয়র কম্যিুনিটি ম্যানেজার সিমন বালমেইনের কাজের ল্যাপটপ ও স্ল্যাক মেসেজিং প্রোগামটি থেকে তিনি ইতিমধ্যে লগ-আউট হয়ে গিয়েছেন। তাই তিনি মনে করেন তারও চাকরি চলে গিয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন। আর তার অন্যান্য সহকর্মীদের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

১০ শতাংশ কর্মী অপসারণের ইঙ্গিতের পর গত জুনে ইলন মাস্কের আরেক প্রতিষ্ঠান টেসলার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন আইনজীবী শ্যানন লিস-রিয়োরদান। তখন এ মামলায় রায় আসে টেসলার পক্ষে। মাস্ক দায়িত্ব নেয়ায় টুইটারে বিনিয়োগ করেছে ক্রিপ্টো-কারেন্সি প্ল্যাটফর্ম বাইন্যান্স। এর আগে, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী, চ্যাংপেং ঝাও বলেন যে একটি অল্প সংখ্যক জনবল কাজকে আরও অর্থবহ করে তুলবে।

চ্যাংপেং ঝাও লিসবনে ওয়েব সামিটে দেওয়া বক্তব্যে টুইটারের সমালোচনা করে বলেছেন যে এই প্রতিষ্ঠানটিতে যে হারে কর্মী রয়েছে, সেই তুলনায় নতুন ফিচার যুক্ত করতে পারেনি। এর আগে ধারণা করা হয়েছিল যে টুইটারের আট হাজার জনবলের প্রায় অর্ধেকই অপসারণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ইলন মাস্ক তার পরিকল্পনার বিষয়ে টুইট করেছেন, যেকোনো উপায়ে টুইটারকে বিল পরিশোধ করতে হবে। টুইটার বেশ কয়েক বছর ধরে কোন লাভ করতে পারেনি এবং এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা গত এক মাস ধরে প্রায় ৩০ কোটিতেই মোটামুটি স্থির রয়েছে।

বিজ্ঞাপন (কেন?)

অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলম মাস্ক বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা এবং প্রযুক্তি খাতে শেয়ার বাজারের দামের পতনের মধ্যেও কোম্পানিটির পেছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছেন। টুইটারের খরচ কমানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দুটি সূত্র জানায়, প্রতিবছর ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অবকাঠামোগত খরচ সাশ্রয়ের উপায় খুঁজতে এরইমধ্যে কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন মাস্ক।

টুইটারের অর্থ সংগ্রহের নতুন পথ, সমালোচিত মাস্ক

টুইটারে এখন থেকে এই ভ্যারিফাইড “ব্লু টিক” চিহ্নের জন্য উক্ত সকল অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীদের প্রতি মাসে ৮ ডলার চার্জ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। খরচ কমানোর পাশাপাশি টুইটারের অর্থ সংগ্রহের এই প্রচেষ্টা সমালোচনার মুখে পড়েছে। ভ্যারিফিকেশন ব্যাজ ছাড়াও, যারা অর্থ দিবে, তাদের টুইটগুলো আরও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হবে। আর বিজ্ঞাপন দেখানো কমিয়ে ফেলা হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু টুইটারের বৈশ্বিক যোগাযোগ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ব্র্যান্ডন বোরম্যান বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে প্রশ্ন করেছিলেন যে, টুইটার কীভাবে মানুষের থেকে অর্থ নেয়ার বিষয়টিকে ন্যায়সঙ্গত ভাবছে, যেখানে তারা সব ব্যবহারকারীকে সমান চোখে দেখতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মাস্কের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অনেক কর্মী তার সাথে দেখা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। মে মাসে  মাস্ক বলেছিলেন যে তার কাজের নীতিগত প্রত্যাশা চূড়ান্ত হবে, এতোটাই বেশি যা তিনি নিজের জন্যও দাবি করেন না। কর্মী অপসারণ কীভাবে টুইটারের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করবে তা স্পষ্ট নয়। মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মি মাস্ক দায়িত্ব নেয়ার পরে ইতিমধ্যেই তার দাবি পূরণের জন্য কয়েকজন কর্মী দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছেন।

এই ব্যাপক অপসারণ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় কী প্রভাব ফেলবে, সেটি এখনো অস্পষ্ট। আর কর্মীদের ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শন এবং রুঢ় ব্যবহারের বিষয়টি মাস্কের জন্য নতুন কিছু নয়।

টুইটারে প্রবেশের পূর্বে মাস্কের একাধিক নাটকীয়তা

গত সপ্তাহে একাধিক নাটকিয়তা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার পর চুয়াল্লিশ বিলিয়ন ডলার চুক্তিতে কোম্পানিটি কিনে নেওয়ার পর টুইটারের প্রধান নির্বাহী হতে যাচ্ছেন মাস্ক। এপ্রিল মাসের মধ্যে কোম্পানির সবচেয়ে বেশি শেয়ারের মালিকে পরিণত হন মাস্ক। মাস শেষ হওয়ার আগেই ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে কোম্পানি কিনে নেওয়ার সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তিনি।

সে সময়ে স্প্যাম অ্যাকাউন্ট দূর করে প্ল্যাটফর্মটিকে বাকস্বাধীনতার জন্য নিরাপদ প্লাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন মাস্ক। কিন্তু মে মাসের মাঝামাঝি মত পাল্টান, প্ল্যাটফর্মে বট ও স্প্যাম অ্যাকাউন্টের সংখ্যা টুইটারের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি বলে অভিযোগ তোলেন। এরপর জুলাই মাসে সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে আসার কথা জানান। কিন্তু টুইটারের পক্ষ থেকে পাল্টা অভিযোগ তুলে বলা হয়, সমঝোতা চুক্তির কারণে অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে আইনত বাধ্য ইলন মাস্ক।

টুইটার এরপর আদালতে যায়। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে মামলার বিচার কাজ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে আবার মত পাল্টান মাস্ক। বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করলে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দেন। টুইটার মাস্কের প্রতিশ্রুতিতে রাজি না হলেও, মাস্ককে দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে বিচার কাজ স্থগিত করে ডেলাওয়্যারের আদালত। সেই সময় শেষ হওয়ার আগেই টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নিলেন উক্ত মাস্ক। এরপর চুক্তি অনুযায়ী পরাগ আগারওয়াল সহ বেশ কিছু কর্মী টুইটার ছেড়ে যান।

এছাড়াও বরখাস্তের পর ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও পরাগ আগারওয়াল আনুমানিক ৪২ মিলিয়ন ডলার পেতে পারেন বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি। ভারতীয় মূল্যে যেটি ৩৪৫ কোটি রুপি। এমনকি এই অর্থের মধ্যে থাকবে তার মূল বেতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার হিসাব ও। পরাগ আগরওয়াল প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় আগে টুইটারে যোগ দিয়েছিলেন। তখন এর কর্মী সংখ্যা এক হাজারের কম ছিল।

রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, সে বছর টুইটার থেকে পরাগ ৩০ মিলিয়নের বেশি আর্থিক সুবিধা পান। এর একটি বড় অংশ এসেছিল টুইটারের শেয়ার হিসেবে। প্রধান নির্বাহী পরাগ আগারওয়ালের সঙ্গে মাস্কের মতবিরোধের বিষয়টি উঠে এসেছিল আদালতে জমা দেওয়া নথিপত্রে থেকেই। তাই আগারওয়ালের বিদায় সেই অর্থে অপ্রত্যাশিত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই আগারওয়ালের প্রস্থানকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন।

সাবস্ক্রাইব করুন The Penguins Club খবরপত্রিকায়

প্রতি শুক্রবার বিশেষ খবর এবং আলোচনায় অংশগ্রহন করতে আপনার ইমেইল দিন।


Tagged:
About the Author

বিগত প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি করছি - বাংলা লেখিকা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.